ছোটগল্প হিসেবে 'কে বাঁচায়, কে বাঁচে' গল্পটির সার্থকতা বিচার :
ছোটগল্প হিসাবে ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ কতটা সার্থক |
ছোটগল্প হিসেবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কে বাঁচায়, কে বাঁচে' গল্পটি কতটা সার্থক হয়েছে আলোচনা করো।
👉 ভূমিকা :
ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা
নিতান্ত সহজ সরল, ........
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
কথাগুলো বলেছিলেন বাংলা ছোটগল্পের সার্থক রূপকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিতার ছন্দে বলা এই অংশতেই রয়েছে সার্থক ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যের যথাযথ বিবরণ। এডগার অ্যালান পো-এর মতে, যে গল্প অর্ধ থেকে এক বা দুই ঘণ্টার মধ্যে এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়, তাকে ছোটগল্প বলে।
ছোটগল্পে জীবনের সামগ্রিক দিকটি উপন্যাসের মতো বিস্তারিতভাবে বর্ণিত না হয়ে, তার খণ্ডাংশ নিয়ে পরিবেশিত হয়। এজন্য ছোটগল্প যথাসম্ভব বাহুল্যবর্জিত, রসঘন ও নিবিড় হয়ে থাকে। সংগত কারণেই এতে চরিত্রের সংখ্যা হয় খুবই সীমিত। ছোটগল্পের প্রারম্ভ ও প্রাক্কাল সাধারণত এবং খানিকটা নাটকীয়ভাবেই শুরু হয়।
👉 ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য :
১) নাটকীয় প্রারম্ভ :
'সেদিন আপিস যাবার পথে মৃত্যুঞ্জয় প্রথম মৃত্যু দেখল - অনাহারে মৃত্যু' - এভাবেই, গল্পকার হঠাৎ 'অনাহারে মৃত্যু'র মুখোমুখি দাড় করালেন গল্পের প্রধান চরিত্র মৃত্যুঞ্জয়কে। 'কয়েক মিনিটে মৃত্যুঞ্জয়ের সুস্থ শরীরটা অসুস্থ হয়ে গেল' - এভাবে এধরণের অভাবনীয় নাটকীয় পরিস্থিতি থেকেই গল্পের পথচলা শুরু হয়।
২) আয়তনের স্বল্পতা :
দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের জীবনযন্ত্রণাকে কমবেশি মাত্র ১১২ টা লাইন ব্যবহার করে লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে বাহুল্যবর্জিত এবং নিবিড় ও নিটল বর্ণনায় উপস্থাপন করেছেন তা থেকে সার্থক ছোটগল্পের রূপই পাঠকের সামনে উঠে আসে।
৩) সীমিত সংখ্যক চরিত্র :
এই গল্পে প্রধান চরিত্র মাত্র তিনজন। প্রধান চরিত্র হল মৃত্যুঞ্জয় এবং সহযোগী দ্বিতীয় ও তৃতীয় চরিত্র হল যথাক্রমে নিখিল ও টুনুর মা। এই তিনজনের কথোপকথনে এবং লেখকের সংযত ও সচেতন ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের শ্রেণি চরিত্র।
৪) জীবনের খন্ডাংশের পরিবেশন :
ছোট্ট পরিসরে সম্পূর্ণ গল্প জুড়ে দুর্ভিক্ষজনিত কারণে সাধারণ মানুষের অনাহারে মৃত্যুকে সামনে রেখে অনুভূতিপ্রবণ মৃত্যুঞ্জয়ের মধ্যে, এই পরিস্থিতিতে তার কর্তব্য বিষয়ে, যে অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল সেটুকুই এই গল্পের প্রধান ভরকেন্দ্র।
৫) ক্ষুদ্রতার মধ্যে বৃহত্তরের ব্যঞ্জনা :
আয়তনে ছোট হলেও ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পটি বৃহত্তর ব্যঞ্জনা বহন করে। মধ্যবিত্ত ও চাকরিজীবী মৃত্যুঞ্জয় স্বাচ্ছন্দময় জীবন কাটানোর সুযোগকে উপেক্ষা করে যেভাবে দুঃখ ও দুর্দশাক্লিষ্ট মানুষের জন্য সুদিনের আশায় নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলে তার মধ্য দিয়ে প্রকৃত মনুষ্যত্বের জয় ঘোষিত হয়েছে।
৬) শেষ হয়ে হইল না শেষ :
মনে রাখতে হবে, নিশ্চিন্ত চাকরিজীবনের সুখ ও স্বাচ্ছন্দকে উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয় যেভাবে স্বেচ্ছায় দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের মত জীবনযন্ত্রণাকে বেছে নিয়েছেন তা ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনের অনুসারী মানুষদের কাছে পাগলামি বলে বিবেচিত হয়েছে। সহযোগী চরিত্র নিখিল মৃত্যুঞ্জয়কে সেভাবেই বিবেচনা করেছেন। বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন তার এই মানসিক বিভ্রান্তির কথা। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। সবকিছুকে উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয় ছেঁড়া ন্যাকড়া পরে, খালি গায়ে, একমুখ দাঁড়ি নিয়ে লঙ্গরখানায় খিচুড়ি চেয়ে খেতে শুরু করে।
মৃত্যুঞ্জয়ের এই ধরনের জীবন বেছে নেওয়া ও তার মধ্য দিয়ে গল্পের সমাপ্তি ঘটা, নিশ্চিতভাবেই সুখী এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনবোধে বিশ্বাসী পাঠক সমাজকে তৃপ্তি দেবে না। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুঞ্জয় স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছিল কিনা - এ প্রশ্ন পাঠককে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে।
👉 উপসংহার :
সুতরাং দেখা যাচ্ছে ছোটগল্পের প্রায় সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিয়েই গল্পটি এগিয়েছে এবং শেষ হয়েছে। সেই সঙ্গে গল্পকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সুনির্বাচিত ইঙ্গিতবহ শব্দ ব্যবহার করে, পর্যাপ্ত ভাবময়তা বজায় রেখে, বিষয়োপুযোগী বাচনভঙ্গি ও স্বতঃস্ফূর্ত বাক্য বিন্যাস ঘটিয়ে গল্পটিকে একটি সার্থক ছোটগল্পের রূপ দিয়েছেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন