ভগিনী নিবেদিতা
ভূমিকা :
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে ভগিনী নিবেদিতার নাম। পৈত্রিক সূত্রে তিনি ছিলেন স্কচ। আধুনিক ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী ও ধর্মনেতা স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ভারতবর্ষে আসেন। ব্রহ্মচর্যে দীক্ষা নেন। ভারতে সমাজ সেবা ও নারী শিক্ষার প্রসারেও নিবেদিতার ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।জন্ম ও বংশ পরিচয় :
১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ২৮ অক্টোবর উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডানগ্যানন শহরে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবেল ছিলেন ধর্মযাজক। মায়ের নাম মেরি ইসাবেলা। মাত্র দশ বছর বয়সে মার্গারেটের বাবা মারা যান। তারপর তাঁর দাদামশাই তথা আয়ারল্যান্ডের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী হ্যামিলটন তাঁকে লালনপালন করেন।
১৮৯৮-৯৯ সালে কলকাতায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে প্লেগ। এ সময় আক্রান্তদের সেবায় রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের সাথে যোগ দেন নিবেদিতা। মধুর অমায়িক ব্যবহার ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দিয়ে অনেক বাঁধা ডিঙিয়ে তিনি সকলের মন জয় করে নেন। নারী শিক্ষা বিষয়ে বিবেকানন্দের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে বাগবাজারে প্রতিষ্ঠা করেন একটি বালিকা বিদ্যালয়। বয়স্ক নারীদের শিক্ষার লক্ষ্যেও কাজ করেছেন তিনি।
এই পর্বে তিনি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনেও যোগ করেন এবং জনসাধারণকে বিলেতি পণ্য বর্জনে উদ্বুদ্ধ করেন । নিবেদিতার চোখে ছিল অখণ্ড স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আর এর জন্যে তিনি প্রবন্ধ, বক্তৃতা ও বিবৃতির মাধ্যমে ভারতবাসীকে স্বাদেশিকতা আর জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত করতে সদা নিবেদিত ছিলেন ।
শিক্ষাজীবন :
মার্গারেট লন্ডনের চার্চ বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। এরপর হ্যালিফ্যাক্স কলেজে তিনি ও তাঁর বোন মেরি পড়াশোনা করেছিলেন।কর্মজীবন :
১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে, সতেরো বছর বয়সে শিক্ষাজীবন শেষ করে মার্গারেট শিক্ষিকার পেশা গ্রহণ করেন। দু’বছরের জন্যে কেসউইকের একটি প্রাইভেট স্কুলে পড়ান। এরপরে একে একে রেক্সহ্যামে (১৮৮৬), চেস্টারে (১৮৮৯) এবং লন্ডনের উইম্বলডনে (১৮৯০) তিনি শিক্ষকতা করেন। কিছুদিন পরে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে উইম্বলডনে নিজে 'রাস্কিন স্কুল' উদ্বোধন করেন। তিনি এই স্কুলে নতুন শিক্ষাপদ্ধতি ব্যবহার করেন।
ধর্মভাবনা :
এই সময়ই মার্গারেট বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন। প্রচলিত ধর্মের গতানুগতিকতায় আস্থা হারিয়ে ফেলেন। তাঁর কাছে ধর্ম হল, ‘‘মাতৃভূমিকে জানা, তাঁর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-আচার-আচরণসমন্বিত হৃৎস্পন্দনকে অনুভব করা; নিজের মায়ের সঙ্গে যে নিকট সম্পর্ক, সেই সম্পর্কে দেশমাতৃকার পূজা, তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, তাঁকে সেবা করা।"*
এমনই এক সময় বিবেকানন্দ বেদান্ত-প্রচার উপলক্ষে ইংল্যান্ড যান। এক ঘরোয়া আলোচনা সভায় বিবেকানন্দের ধর্মচিন্তা, সমাজ ভাবনা, স্বদেশপ্রেম প্রভৃতি তাঁকে অনুপ্রাণিত করে।
ভারত আগমন ও সন্যাস জীবন :
১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি স্বদেশ ও পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে মার্গারেট চলে আসেন ভারতে। এই সময় বিবেকানন্দের কাছে ভারতের ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, জনজীবন, সমাজতত্ত্ব, প্রাচীন ও আধুনিক মহাপুরুষদের জীবনকথা শুনে মার্গারেট ভারতকে চিনে নেন। ভারতে আসার কয়েক দিন পর রামকৃষ্ণ পরমহংসের স্ত্রী সারদা দেবীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এরপর ২৫ মার্চ স্বামী বিবেকানন্দ নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগান বাড়িতে তাঁকে ব্রহ্মচর্য ব্রতে দীক্ষা দেন। তিনিই মার্গারেটের নতুন নাম রাখেন ‘নিবেদিতা’।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নিবেদিতা :
এক সময় তিনি ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। নিবেদিতা ঘোষণা করেন, “আমার কাজ এই জাতিকে জাগ্রত করা।" (ফরাসী জীবন চরিত, পৃঃ ২২৫)। কিন্তু রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের নিয়মানুসারে ধর্ম ও রাজনীতির সংস্রব ঠেকাতে সংঘের কেউ রাজনীতিতে জড়াতে পারতেন না। নিবেদিতা স্বামী ব্রদ্ধানন্দকে জানালেন, “আমি রাজনীতি ছাড়তে পারব না। আমি এর সংগে একাত্ম হয়ে গিয়েছি। আমি বরং প্রাণত্যাগ করব, তবু একে ছাড়ব না”। যদিও সারদা দেবী ও রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তার আমৃত্যু সুসম্পর্ক বজায় ছিল।শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতি ভাবনা :
তাঁর প্রতিভা বহুমুখী— তার প্রকাশও ঘটে জীবনের বহু ধারায়। মডার্ন রিভিউ, দ্য স্টেটসম্যান, অমৃতবাজার পত্রিকা, ডন, প্রবুদ্ধ ভারত, বালভারতী প্রভৃতি পত্রিকায় ধর্ম, সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, শিল্প ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য বইগুলি হল 'কালী দ্য মাদার', 'ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ', 'ক্রেডল টেলস অফ হিন্দুইজম', 'দ্য মাস্টার অ্যাজ আই শ হিম', ‘হিন্টস অন ন্যাশনাল এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া’, ‘অ্যাগ্রেসিভ হিন্দুইজম’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসবের পাশাপাশি নিবেদিতা রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র বসু, শ্রী অরবিন্দ, ব্যারিস্টার পি.মিত্র প্রমুখ মনীষীর সাথেও যোগাযোগ রেখেছিলেন।শেষ জীবন :
ভারতের গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়ায় অতিরিক্ত পরিশ্রম করার ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাওয়া বদলের জন্য জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দার্জিলিঙে বেড়াতে যান। ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর দার্জিলিঙে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। জীবনের শেষ মুহূর্তে তিনি বলেন, ‘দ্য বোট ইজ সিঙ্কিং, বাট আই শ্যাল সি দ্য সান রাইজ’। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৪৪ বছর।
স্বীকৃতি :
বিধাননগরে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ২০১০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত ভবনটি নিবেদিতার নামে নামাঙ্কিত করা হয়। তামিলনাড়ুর চেন্নাইতে ভগিনী নিবেদিতার প্রতিষ্ঠিত অ্যাকাডেমিটির নাম রাখা হয় সিস্টার নিবেদিতা অ্যাকাডেমি। তাঁর নামে একাধিক বিদ্যালয় ও কলেজের নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৬৮ সালে ভারত সরকার তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে একটি ডাকটিকিটও প্রকাশ করে।
উপসংহার :
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিয়াছেন, “ভারতবর্ষকে বিদেশী যাঁরা সত্যিই ভালোবেসেছিলেন তার মধ্যে নিবেদিতাঁর স্থান সব চেয়ে বড়।” তাঁর বই মাতৃরূপা কালী পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর "ভারতমাতা" ছবিটি আঁকেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “নিজেকে এমন করিয়া সম্পূর্ণ নিবেদন করিয়া দিবার আশ্চর্য শক্তি আর কোনো - মানুষে প্রত্যক্ষ করি নাই ------মানুষের সত্যরূপ, চিৎরূপ যে কী, তাহা যে তাঁহাকে জানিয়াছে, সে দেখিয়াছে। মানুষের আন্তরিক সত্তা সর্বপ্রকার স্থূল আবরণকে একেবারে মিথ্যা করিয়া দিয়া কিরূপ অপ্রতিহত তেজে প্রকাশ পাইতে পারে তাহা দেখিতে পাওয়া পরম সৌভাগ্যের কথা। ভগিনী নিবেদিতার মধ্যে মানুষের সেই অপরাহত মাহাত্ম্যকে সম্মুখে প্রত্যক্ষ করিয়া আমরা ধন্য হইয়াছি।” নিবেদিতার সম্বন্ধে বলিতে গিয়ে স্বামিজী বলেছিলেন, বহুব্যক্তিত্বের একত্র সমাবেশ নিবেদিতার মধ্যে লক্ষ্য করা যাষ।-----------xx----------
* ভারতচেতনায় ভগিনী নিবেদিতা: সংকলন ও সম্পাদনা - স্বামী চৈতন্যানন্দ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন