কে বাঁচায়, কে বাঁচে গল্পের নামকরণ :
ভূমিকা :
১৯৪২ সালের আগস্টে ভারতছাড় আন্দোলন, অক্টোবরের ভয়ংকর সাইক্লোন, গ্রাম বাংলায় বন্যার ভয়াবহতা, জাপানি আক্রমণের ভয়ে ব্রিটিশ সরকারের 'পোড়ামাটি নীতি' - সব মিলিয়ে বাংলার জনজীবন ভয়ংকর সংকটের মধ্যে পড়ে। এই সংকটকে সামনে রেখে এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তির কালবাজারি ও এবিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের নিদারুণ উদাসীনতায় এই সংকট অমানবিক চেহারা নেয়।
এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে মানবতাবাদী কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন তার কালজয়ী ছোটগল্প 'কে বাঁচায়, কে বাঁচে'।
নামকরণের সার্থকতা বিচার :
এই পটভূমির কথা মাথায় রাখলে গল্পের নামকরণ সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা তৈরি হয়ে যায়। এরপর গল্পের গভীরে ঢুকলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই নামকরণের সার্থকতা কতটা।
১) পাঠক ও পাঠ্যের মধ্যে সেতু নির্মাণ :
বস্তুত, সাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ, নামকরণের মাধ্যমে পাঠক ও পাঠ্যের মধ্যে একটি ভাব সেতু নির্মিত হয়, যাকে অবলম্বন করে পাঠক গল্পের গহীনে প্রবেশের প্রেরনা পায়।
২) নামকরণ মূলত তিনভাবে
গল্প বা কবিতাসহ সমস্ত সাহিত্যকর্মের নামকরণ মূলত তিনভাবে হয়ে থাকে। এগুলো হল, বিষয়কেন্দ্রিক, চরিত্রকেন্দ্রিক অথবা ব্যঞ্জনাধর্মী।
৩) বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ :
আলোচ্য গল্পে আমরা দেখতে পাই দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ কলকাতা শহরের বড় বড় ফুটপাতে অনাহারে অসহয়ের মৃত্যুবরণ করছে। বিলাসিতার আতিশয্যে মজে থাকা উচ্চবিত্তের মানুষগুলোর এবিষয়ে কোন হেলদোল নেই। ফলে এদের কোন দাক্ষিণ্যও এই অসহায় মানুষগুলো পায়নি। স্বাভাবিক ভাবে এই মানুষগুলো নিদারুণ অনাহারকে সঙ্গী করে 'উচ্ছিষ্টের আস্তাকুড়ে বসে উচ্ছিষ্ট নিয়ে কাড়াকুড়ি করেছে।
ঘটনার আকস্মিতায় এই গল্পের নায়ক মৃত্যুঞ্জয় এই অমানবিক চালচিত্রের মুখোমুখি হয় তার অফিসে যাওয়ার পথে। মানবিক মূল্যবোধের অধিকারী এই মানুষটি স্বচ্ছল জীবনযাপনের সুযোগকে উপেক্ষা করে এই অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দুর্ভিক্ষের ব্যপকতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে তার একার এই উদ্যেগ বিফলে যেতে থাকে। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির অভিঘাতে সে ও তার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থতার গভীর অতলে হারিয়ে যেতে থাকে। নিজের সুরক্ষিত সামাজিক অবস্থান থেকে সরে এসেও মৃত্যুঞ্জয় কাউকে বাঁচাতে পারেনি।
৪) ব্যঞ্জনাধর্মী উপস্থাপনা :
গল্পের শেষে এসে দেখি সামাজিক অবক্ষয় ও উচ্চবিত্ত মানুষের সীমাহীন উদাসীনতার কারণে বাঁচাতে চাওয়া মৃত্যুঞ্জয় এবং বাঁচতে চাওয়া নিরন্ন মানুষ এক বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘটনার এই প্রেক্ষাপটে অনিবার্য হয়ে উঠেছে এক অমোঘ প্রশ্ন - কে বাঁচায়, আর কে বাঁচে। শ্রেণি বৈষম্যের বিষম ফল হিসাবে এই প্রশ্ন গভীর ব্যঞ্জনায় পাঠকের কাছে উপস্থিত হয়।
উপসংহার :
তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ - এই ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণটি সুপ্রযুক্ত সার্থক হয়ে উঠেছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন