“এভাবে দেশের লোককে বাঁচানো যায় না।”
ক) কে, কোন প্রসঙ্গে এ কথা ভাবছে?
খ) এই ভাবনার মধ্য দিয়ে তার চরিত্রের কোন বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে?
গ) কে, কেন এবং কীভাবে দেশের লোককে বাঁচাতে চায়?
ক) কে, কোন প্রসঙ্গে ভাবছেন :
কে ভাবছেন :
কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায় রচিত 'কে বাঁচায়, কে বাঁচে' গল্প থেকে উদ্ধৃত অংশটি নেওয়া হয়েছে। এই গল্পের প্রধান চরিত্র মৃত্যুঞ্জয়ের বন্ধু নিখিল এ কথা ভাবছে।
কোন প্রসঙ্গে ভাবছেন :
মৃত্যুঞ্জয় ১৩৫০ সালে দুর্ভিক্ষে অনাহারী মানুষের মৃত্যু দেখে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। তাই তাদের সেবায় সে তার মাইনের সব টাকাই রিলিফ ফান্ডে দিয়ে দিতে চায়। নিজের পরিবারের কথা না ভাবায় এবং রিলিফের মাধ্যমে এই মৃত্যুকে ঠেকানোর চেষ্টার অসারতার কথা প্রকাশ করতে গিয়ে নিখিল একথা বলেছে।
খ) বক্তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য :
বন্ধু বৎসল মানুষ :
আসলে নিখিল অত্যন্ত বন্ধুবৎসল মানুষ। তাই সে মৃত্যুঞ্জয়কে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে তার ভাবনায় অসঙ্গতি কোথায়। সে তার পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তার এই ভাবনাকে তুলে ধরে।
আন্তরিক ও মানবিক :
নিখিল আবেগ অনুভূতিহীন মানুষ নয়। মানুষের প্রতি আন্তরিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের কারণেই সে প্রতি মাসে তিন জায়গায় নিয়মিত অর্থ সাহায্যও পাঠায়।
যুক্তিবাদী চিন্তা:
কিন্তু নিখিল জানে, রিলিফ মানে আসলে একজনের বদলে আরেকজনকে খাওয়ানো। এতে মূল সমস্যার সমাধান হয় না। এ কারণেই বলেছেন, এভাবে দেশের লোককে বাঁচানো যায় না। তার যুক্তিবাদী চিন্তা রিলিফের নামে ভিক্ষা দেওয়াকে ‘অস্বাভাবিক পাপ’ বলে মনে করে। কারণ, জীবনধারণের অন্নে মানুষের যে দাবি, তা এতে ন্যায্যতা পায় না। মধুর আধ্যাত্বিক নীতির মোড়কে রিলিফের নামে যা করা হয়, নিখিলের ব্যাখ্যায়, তা আসলে অনিয়ম।
বাস্তববাদী মন :
নিখিল বিশ্বাস করে দশ জনকে খুন করার চেয়ে নিজেকে না খাইয়ে মারা বড় পাপ। মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে নিখিলের এই ভাবনা ‘পাশবিক স্বার্থপরতা’। নিখিলের ব্যাখ্যা হল, এই স্বার্থপরতা যদি নিরন্ন মানুষগুলোকে শেখানো যেত, তবেই অন্ন থাকতে এই বাংলায় কেউ না খেয়ে মরত না। মজুতদারের কাছ থেকে সে অন্ন তারা বের করে আনত; নিখিলের কথায়, ‘সে অন্ন হাজার মাইল দূরেই থাক, আর একত্রিশটা তালা লাগানো কোন গুদামেই থাক’। তাই সে বোঝে, এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতন না করে, শুধুমাত্র রিলিফ দিয়ে, নিজেকে না খাইয়ে মেরে, দেশের মানুষকে বাঁচানো যাবে না।
সুতরাং নিখিলের এই ভাবনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, সে একজন বাস্তববাদী ও হৃদয়বান মানুষ। বন্ধু বৎসল্য তার সহজাত। সমাজ বদলের ‘প্রাচীন ও সবচেয়ে পচা ঐতিহ্য ও আদর্শবাদে’ নয়, সমাজ বদলের নতুন ভাবনায় সে জারিত।
গ) কে, কেন, কীভাবে বাঁচাতে চায় :
কে বাঁচায় :
১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের পটভূমিতে লেখা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’। এই গল্পের নায়ক মৃত্যুঞ্জয় দুর্ভিক্ষ পীড়িত, অন্নহীন, অসহায় মানুষদের বাঁচাতে চেয়েছেন।
কেন বাঁচাতে চায় :
মৃত্যুঞ্জয় এই গল্পের মাস মাইনের কেরানি। মাইনে যা পায়, তাতে নয় জন সদস্যের পরিবার কোনরকমে খেয়ে পরে বাঁচতে পারে। এভাবেই তার দিন কাটছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন অফিস যাওয়ার পথে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের অনাহারে মৃত্যু দেখে সে ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়ে। কারণ, সে “মানব সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন ও সবচেয়ে পচা ঐতিহ্য আদর্শবাদের কল্পনা তাপস”।
সে ভাবতে থাকে এই মৃত্যুর কারণ কি? কীভাবে তাকে এড়ানো যায়? এক্ষেত্রে তার কোন করণীয় আছে কিনা। এসব ভাবতে গিয়েই সে আবিষ্কার করে, এ মৃত্যুর জন্য সে নিজেও দায়ী। কারণ, সবকিছু জেনেশুনেও এতকাল সে চারবেলা পেট ভরে খেয়েছে। এটা তার কাছে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যই সে দুর্ভিক্ষ পীড়িত অনাহারি মানুষদের বাঁচাতে চায়।
কীভাবে বাঁচাতে চায়:
এই অনাহারি মানুষদের বাঁচানোর জন্য সে সিদ্ধান্ত করে, মাস মাইনের সমস্ত টাকাটাই সে রিলিফ ফান্ডে দান করে দেবে। দেয়ও তাই। এক সময় শহরের আদি অন্তহীন ফুটপাত, বিভিন্ন লঙ্গরখানায় ঘুরে অন্নপ্রার্থী মানুষের ভিড়ে মিশে, সে বুঝে নিতে চেষ্টা করে - “কোথা থেকে কীভাবে কেমন করে সব উলটপালট হয়ে গেল”। অন্নহীন মানুষের সঙ্গে ফুটপাতে থেকে বোঝার চেষ্টা করে, না খেয়ে মরা কী এবং কেমন? জানার চেষ্টা করে, কত কষ্ট হয় না খেয়ে মরতে। উপলব্ধির চেষ্টা করে, ক্ষুধার যাতনা, না মৃত্যু যন্ত্রণা বেশি ভয়ংকর। এভাবে পারিবারিক শান্তির বাতাবরণ কিংবা অফিসের নিরাপদ চাকরির নিশ্চয়তা ছেড়ে অন্যহীন মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের পাশে থেকে মৃত্যুঞ্জয় তাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে, তাদের বাঁচাবার চেষ্টা করেছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন