“অনেক, অনেক দূরে আছে মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ,”
ক) কাকে, কেন 'মহুয়ার দেশ' বলা হয়েছে?
খ) কবিতাটিতে স্বপ্ন ভঙ্গের কোন্ কথা আছে?
গ) কবির দেখা মহুয়ার দেশটি কেমন তা কবিতা অবলম্বনে বর্ণনা করো।
অথবা,
কবি মহুয়ার দেশের কী বর্ণনা দিয়েছেন?
ঘ) এই মহুয়ার দেশ কীভাবে কবির চেতনাকে (কবিমনকে) প্রভাবিত করেছে তা নিজের ভাষায় লেখো।
ক) মহুয়ার দেশ বলার কারণ :
কবি সমর সেনের লেখা কবিতা ‘মহুয়ার দেশ’ থেকে উদ্ধৃত অংশটি নেওয়া হয়েছে। এই কবিতায় ‘মহুয়ার দেশ’ বলতে কলকাতা শহর থেকে বহু দূরে শাল, পিয়াল, দেবদারু ও মহুয়া গাছে ভরা অরণ্য-ভূমিকে বোঝানো হয়েছে। ভৌগলিক দিক দিয়ে অঞ্চলটি রাঢ় বঙ্গের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা।
এই এলাকাকে ‘মহুয়ার দেশ’ বলার কারণ হল, এখানে প্রচুর পরিমাণে অপরূপ সৌন্দর্য ও ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ মহুয়া গাছ জন্মায়। কবির ভাবনায় মহুয়া বনের অপরূপ ফুল ও মহুয়ার গন্ধ কবির নাগরিক জীবনের একঘেয়েমি, অবসাদ, বিসন্নতা ও ক্লান্তি কাটিয়ে মুক্তির আনন্দ দিতে পারে। মহুয়া গাছের সৌন্দর্য ও গুণের প্রতি তাঁর এই সীমাহীন টান ও ভালোবাসার জন্যই কবি এই অঞ্চলকে ‘মহুয়ার দেশ’ বলে অভিহিত করেছেন।
খ) কবিতায় স্বপ্ন ভঙ্গের কথা :
কবি সমর সেন স্বপ্ন দেখেছিলেন, নগর জীবনের একঘেয়েমি ও ক্লান্তিকর জীবন থেকে মুক্তি পাবেন ‘মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ’-এ গেলে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। কারণ, তাঁর এই স্বপ্নের দেশে ততদিনে হানা দিয়েছে যন্ত্র সভ্যতা। তাই রাতের নিবিড় অন্ধকারে শোনা যায় কয়লা খনির গভীর ও বিশাল শব্দ যা অত্যন্ত অসহ্য লাগে কবির কাছে। স্বপ্নভঙ্গের এই কথাই লিখেছেন এই কবিতায় :
এখানে অসহ্য নিবিড় অন্ধকারে
মাঝে মাঝে শুনি
মহুয়া বনের ধারে কয়লার খনির
গভীর বিশাল শব্দ,
শুধু তাই নয়, তিনি বিষন্ন চিত্তে লক্ষ্য করেছেন, শিশির ভেজা সবুজ সকালেও মানুষের শরীরে লেগে আছে ধুলোর কলঙ্ক। নিদ্রাহীন এইসব মানুষের চোখে ভিড় করে আসা যন্ত্র সভ্যতার বিপন্নতাই কবির কাছে স্বপ্নভঙ্গের নিদারুণ ছবি হয়ে ফুটে উঠেছে।
গ) কবিতায় মহুয়ার দেশের বর্ননা :
শেষ পর্যন্ত কবির স্বপ্নভঙ্গ হলেও একসময় এই মেঘ নদীর অরণ্যভূমি তাকে মুগ্ধ করেছিল। তাই এই কবিতায় গ্রামীণ প্রকৃতির অনুষ্ঙ্গে তিনি দিয়েছেন মহুয়ার দেশের রোমান্টিকতায় মোরা এক অপরূপ নৈসর্গিক বর্ণনা।
অনেক অনেক দূরে আছে মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ
সমস্ত ক্ষণ সেখানে পথের দু'ধারে ছায়া ফেলে
দেবদারুর দীর্ঘ রহস্য
শুধু তাই নয়, নাগরিক জীবনের ক্লান্তি সরিয়ে মহুয়ার দেশ যেভাবে কবির জীবনে অপার শান্তি ও মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিল তাও এই কবিতায় তুলে ধরেছেন। এই বর্ণনার মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে মহুয়ার দেশের আরও এক রোমান্টিক বর্ণনা। কবি লিখেছেন,
আর দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস
রাতের নির্জন নিঃসঙ্গতাকে আলোড়িত করে।
আমার ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়া-ফুল,
নামুক মহুয়ার গন্ধ।
এভাবে অসাধারণ চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবি তার স্বপ্নের মহুয়ার দেশকে সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরেছেন।
ঘ) কবি চেতনায় মহুয়ার দেশের প্রভাব :
সমগ্র কবিতা জুড়ে মহুয়ার দেশ ও তার মনমুগ্ধকর অপরূপ সৌন্দর্য এবং কবির চেতনায় তার প্রভাব বর্ণিত হয়েছে। নাগরিক কবি নগর জীবনের একঘেয়েমি ও ক্লান্তির ঘেরাটোপ থেকে বের হতে চেয়েছেন। মহুয়ার দেশে কবি সেই ক্লান্তি মুক্তির রসদ খুঁজে পেয়েছেন। কবির মনে হয়েছে, এই দেশের পথের দুধারে সারি সারি দেবদারু গাছের রহস্যময় ছায়া আর রাত্রির নির্জনতায় আলোড়ন তোলা সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস একঘেয়েমি কাটাতে সাহায্য করবে।
আর দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস
রাত্রের নির্জন নিঃসঙ্গতাকে আলোড়িত করে।
শুধু তাই নয়, মহুয়া বনের মহুয়া ফুল ও মহুয়ার গন্ধ কবির নাগরিক জীবনের ক্লান্তির উপরে শান্তির বারি বর্ষণ করবে বলে তাঁর বিশ্বাস। তাই তাঁর কামনা :
আমার ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়া ফুল,
নামুক মহুয়ার গন্ধ।
এভাবে কবি চেতনায় মহুয়ার দেশ নাগরিক জীবনের একঘেয়েমি ও ক্লান্তি সরিয়ে মুক্তির বার্তা পৌঁছে দেয়।
-----------xx---------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন