“কেন তবে লেখা, কেন গান গাওয়া / কেন তবে আঁকাআঁকি”
“কেন তবে লেখা, কেন গান গাওয়া / কেন তবে আঁকাআঁকি” |
ক) প্রশ্নগুলি কার? কোন প্রসঙ্গে করেছেন?
খ) কবির মধ্যে কেন এই প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে উঠেছে?
অথবা,
একথা বলার কারণ কী?
গ) এই মন্তব্যটির মধ্য দিয়ে কবির কোন্ বিশেষ মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে?
ক) প্রশ্নগুলি কার? কোন প্রসঙ্গে করেছেন?
উদ্ধৃত অংশটি কবি মৃদুল দাশগুপ্তের ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ নামক কবিতা থেকে গৃহীত হয়েছে। উদ্ধৃত অংশে যে প্রশ্নগুলি এসেছে তা আসলে কবি নিজেই নিজের বিবেকের কাছে করেছেন।
বর্তমান শতকের প্রথম দশকের দ্বিতীয়ার্ধে এপার বাংলায় শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে যে কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, তাকে পটভূমি করেই কবি এই কবিতা লিখেছেন। আন্দোলনের একটি পর্যায়ে হিংসাত্মক পরিবেশ তৈরি হয়। নির্বিচারে মানুষের মৃত্যুকে একটি নিরীহ কর্মের মতো বিবেচিত হতে থাকে। অধিকাংশ মানুষই প্রতিক্রিয়া হীন থাকাকেই শ্রেয় বলে বিবেচনা করতে থাকে।
কিন্তু কবির মধ্যে ছিল প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। মনের মনিকোঠায় জমা ছিল মানুষের জন্য প্রেম ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতার মূল্যবান সত্তা। এই সত্তাই তাঁকে প্ররোচিত করে প্রতিবাদী হতে। ঠিক এই পটভূমিতেই কবি উদ্ধৃত কবিতার মধ্যে উদিষ্ট প্রশ্নগুলি করেছেন।
খ) কবির মধ্যে কেন এই প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে উঠেছে?
অথবা,
একথা বলার কারণ কী?
কবি নজরুল এক সময় লিখেছিলেন, “রক্ত ঝরাতে পারিনা তো একা / তাই লিখে যাই এ রক্ত লেখা”। আসলে সমাজ সচেতন ও মানবিক মূল্যবোধের অধিকারী শিল্পী সত্তা অবলীলায় মানুষের রক্ত ঝরাতে পারে না। পারেনা এমন কাজের স্বীকৃতি দিতেও। কিন্তু মানুষের মূল্যবোধ যখন তলানিতে ঠেকে, সামাজিক অবক্ষয় যখন জ্বলন্ত আগুনের মত মূল্যবোধগুলোকে গিলে খায়, তখন একজন স্বাধীনচেতা কথা শিল্পী নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। কলমকেই তিনি বেছে নেন রক্তলেখায় প্রতিবাদের বারুদ তৈরিতে ইন্ধন দিতে।
কবি মৃদুল দাশগুপ্ত আলোচ্য কবিতায় ঠিক সেই কাজটি করতে চেয়েছেন। তিনি দেখেছেন, সাধারণ মানুষের অসহায় মৃত্যুবরণ। দেখেছেন নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মেয়ের ছিন্নভিন্ন দেহ, যা যেকোনো সংবেদনশীল মানুষকে বেদনা হত ও অস্থির হয়ে উঠতে বাধ্য করে।
কিন্তু কবি দেখেছেন অবাক বিস্ময়ে চারপাশের মানুষ কেমন যেন প্রতিবাদ হীন এবং নির্লিপ্ত। এই পরিস্থিতি কবির সংবেদনশীল মনকে অস্থির করে তোলে। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করাকে আরও বড় অন্যায় বলে বিবেচিত হয়। আর এই পরিস্থিতিতেই বিবেকের তাড়নায় উপরোক্ত প্রশ্নগুলি তার কাছে অনিবার্য হয়ে ওঠে।
গ) এই মন্তব্যটির মধ্য দিয়ে কবির কোন্ বিশেষ মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে?
প্রত্যেক শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ জানে, তার বেড়ে ওঠার পিছনে রয়েছে এই সমাজের সাধারণ খেটে খাওয়া কৃষিজীবী মানুষের অপরিসীম অবদান। তাই সমাজের এই মানুষদের প্রতি প্রত্যেক শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের রয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতা। কবি মৃদুল দাশগুপ্ত সেই দায়বদ্ধতার কথা ভুলে যাননি। তাই কবিতার শুরুতেই ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ থেকে অন্যান্য সহ-নাগরিকদের হিংসা কবলিত মানুষের পাশে না থাকার বিষয়টিকে প্রশ্ন-চিহ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন :কেন তবে লেখা, কেন গান গাওয়ামানবিক মূল্যবোধ শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের আর এক সত্তা যা তাকে ভালোবাসতে শেখায়, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু অসহায় মানুষের মৃত্যু দেখেও অনেক মানুষ পাশ কাটিয়ে চলে যেতে দ্বিধা করেনা। মানবিক মূল্যবোধের এই অবক্ষয় কবিকে অস্থির করে তোলে। তাই এই অবক্ষয়কে সামনে রেখে তিনি প্রশ্ন তোলেন, আমরা যদি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারি তবে আমাদের
কেন তবে আঁকাআঁকি?
কেন ভালোবাসা কেন-বা সমাজ
কিসের মূল্যবোধ!
মানবিক মূল্যবোধের অধিকারী একজন মানুষ, মানুষের উপর হয়ে চলা নির্মম অত্যাচারকে মেনে নিতে পারে না। কারণ, এই মূল্যবোধের ভিতরেই থাকে এক প্রতিবাদী সত্তা। কবি মৃদুল দাশগুপ্ত সেই সত্তার অধিকারী শুধু নয়, সেই সত্তার প্রচার এবং প্রসারেও তাঁকে সচেষ্ট থাকতে দেখি। আর এ কারণেই নাগরিকের কাছে প্রশ্ন তুলেছেন নিখোঁজ মেয়েটির পক্ষে বিচার দাবি করে। তিনি লিখেছেন,
আমি কি তাকাব আকাশের দিকে
বিধির বিচার চেয়ে?
বাস্তববাদী কবি জানেন, এই চাওয়ার আসারতার কথা। তিনি জানেন, প্রতিবাদই এই অন্যায়ের একমাত্র প্রতিবিধান। তাই মানুষকে প্রতিবাদী করে তুলতে হাতে তুলে নিয়েছেন ‘রক্ত লেখা’র দায়িত্ব। বিবেককে কলম এবং কবিতাকে বারুদের চেহারায় দেখতে চেয়েছেন তিনি। আর এই উদ্দেশ্যেই তিনি লিখেছেন এই কবিতা, যাতে আপামর মানুষের বিবেক জেগে ওঠে এবং প্রতিবাদে পথে নামে অন্যায় ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে।
-----------xx---------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন