দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান
“বিজ্ঞানই সভ্যতার উন্নতির মাপকাঠি। বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানেই সমাজের অগ্রগতি।”–আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়
ভূমিকা :
সভ্যতার আদি লগ্নে মানুষ ছিল অরণ্যচারী ও গুহাবাসী। কালক্রমে তার বুদ্ধির বিকাশ ঘটলো। বুদ্ধি জন্ম দিল চেতনার। এই চেতনার আলোয় উদ্ভাসিত হলো মানবসমাজ। ফলে মানুষ ক্রমে দুরন্ত নদীকে বশ করলো, হার মানালো দুস্তর সমুদ্র ও অনন্ত মহাকাশকে। গড়ে উঠলো মানব সভ্যতার সুরম্য ইমারত। এই গঠনকার্যে যার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ অবদান রয়েছে, তা হল বিজ্ঞান ও মানুষের বিজ্ঞান চেতনা।
বিজ্ঞান কী
বিজ্ঞান হলো বিশেষ জ্ঞান বা বিমূর্ত জ্ঞান, বিভিন্ন প্রযুক্তির মধ্যে যার বাস্তব রূপায়ণ ঘটে। উন্নত সভ্যতার মূল চাবিকাঠিই হল বিজ্ঞান।
বিজ্ঞানের জয়যাত্রা :
যে দিন থেকে মানুষ আগুনের ব্যবহার শিখেছে, চাকা আবিষ্কার করেছে, সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। শিল্পবিপ্লবের সময়কালে বাষ্পশক্তির আবিষ্কার এই জয়যাত্রাকে করেছে তরান্বিত। এরপর আবিষ্কার হল বিদ্যুৎশক্তি। বিজ্ঞানলক্ষ্মীর সর্বশেষ দুটি শক্তিবর হল পারমাণবিক শক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এই সব মহার্ঘ্যদানে বলীয়ান হয়ে মানুষ গড়ে তুলেছে নতুন সভ্যতা।
দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের দান :
দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। প্রভাতের প্রত্যুষলগ্ন থেকে নিশীথে শয্যাগ্রহন পর্যন্ত আমাদের জীবনে ছায়াসঙ্গী এই বিজ্ঞান। প্রভাতে অ্যালার্ম ঘড়ির কলরবে শুরু হয় আমাদের সকাল। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সংবাদ ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় সংবাদপত্র, বেতারে এবং দূরদর্শনের মধ্যেমে। চলভাষে প্রিয়জনের সাথে সেরে নেওয়া হয় প্রয়োজনীয় কথাবার্তা। টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ইত্যাদির উপস্থিতিতে গৃহকোণ আজ পরিণত হয়েছে ছোটো ছোটো বিজ্ঞান-গৃহে।
কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান :
কৃষিক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের অবদান যথেষ্ট। ভূমিকর্ষণ থেকে বীজ বপন, জলসেচ, ফসল তোলা, ঝাড়াই-মাড়াই, সংরক্ষণ ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই লেগেছে বিজ্ঞানের জিয়নকাঠির ছোঁয়া। বিজ্ঞানের অকৃপণ দানেই ঊষর মরু হয়ে উঠেছে শস্য প্রসবিনী।
শিল্পক্ষেত্রে বিজ্ঞান :
শিল্পে বিপ্লব এনেছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞান চালিত বিভিন্ন যন্ত্রপাতির দানবীয় শক্তিতে গতি এসেছে কাজে। কলকারখানা, ফ্যাক্টরি, শিল্পসংস্থা প্রভৃতি শিল্পক্ষেত্রে আজ বিজ্ঞান তার ডালি নিয়ে হাজির হয়েছে।
চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান :
বিজ্ঞান চিকিৎসাজগতে এনেছে অভাবনীয় পরিবর্তন।বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির প্রতিষেধক, ওষুধপত্র ও টিকা আবিষ্কারের ফলে মৃত্যুহার বহুলাংশে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। এক্স-রে, ইসিজি, হৃৎপিণ্ড পরিবর্তন, ব্রেন অপারেশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অবদান রয়েছে। কম্পিউটার নামক গণকযন্ত্র ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবিষ্কার চিকিৎসাক্ষেত্রে এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান :
শিক্ষা সংক্রান্ত অধিকাংশ জিনিসই বিজ্ঞানের কৃপাধন্য। বই, খাতা, কলম, বোর্ড সবই বিজ্ঞানের দান । আজকালকার
শিক্ষা ব্যবস্থায় স্থান করে নিয়েছে ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির নানা উপকরণ। কাঠের ব্লাকবোর্ডের জায়গা নিয়েছে ডিজিটাল বোর্ড।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিজ্ঞান :
যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিজ্ঞান এনেছে দুরন্ত গতি। দূরকে করেছে নিকট। মানুষ আজ পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে অসীম আকাশে পাড়ি দিচ্ছে বিজ্ঞানের কল্যাণে। ফাইভ-জি ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক ড্রাইভার বিহীন এবং নিরাপদ পথ চলার হাত-ছানি দিচ্ছে মানুষকে।
অবসর বিনোদনে বিজ্ঞান :
মানুষের কর্মজীবনে ক্লান্তি দূরীকরণে অবসর বিনোদনের জন্য বিজ্ঞান দিয়েছে টিভি, সিনেমা, কম্পিউটার, মোবাইল আরো অনেক কিছু।
প্রযুক্তিবিদ্যায় বিজ্ঞান :
দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও বিপ্লব এসেছে। ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপ প্রভৃতি সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে পৃথিবী গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। ইন্টারনেট ও মুঠোফোনের এক ছোঁয়ায় তামাম দুনিয়া চলে এসেছে মুঠোয়।
বিজ্ঞানের কুফল :
তবে প্রদীপের তলায় যেমন অন্ধকার থাকে, ঠিক তেমনি বিজ্ঞানেরও এক হাতে রয়েছে অমৃত ও অপর হাতে বিষভাণ্ড। বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ। পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে বিজ্ঞানের অগ্রগতি। বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান মানুষ আজ মারণাত্মক অস্ত্র নিয়ে রণোন্মত্ত। ড্রোন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মনুষ্য বিহীন বিমান দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নির্বিচার ধ্বংস-যজ্ঞ চালাচ্ছে মানুষ অবলীলায়।
উপসংহার :
বস্তুত, মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হলেই বিজ্ঞান হয়ে উঠবে প্রগতির হাতিয়ার আর অগ্রগতির বাহন। সুতরাং, বিজ্ঞানের সঙ্গে মানুষের শুভবুদ্ধির মেলবন্ধনেই পৃথিবী হয়ে উঠতে পারে কল্পলোকের স্বর্গ-উদ্যান। তাই অকল্যাণকর কাজে নয়, মানুষের মঙ্গলসাধনে ব্যবহার করতে হবে বিজ্ঞান ও তার প্রযুক্তিকে।
--------xx---------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন