“শীতের দুঃস্বপ্নের মতো।”
ক) কার এমন মনে হয়েছে?
খ) এমন মনে হওয়ার কারণ কী?
গ) কবি কীভাবে এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন?
ঘ) তিনি কী সত্যিই মুক্তি পেয়েছিলেন ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতা অবলম্বনে লেখো।
ক) কার মনে হয়েছে :
নাগরিক কবি সমর সেনের লেখা ‘কয়েকটি কবিতা’ নামাঙ্কিত কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘মহুয়ার দেশ’ নামক কবিতা থেকে উদ্ধৃত অংশটি গৃহীত হয়েছে। এই কবিতায় বর্ণিত নগর জীবনের বিষাক্ত ধোঁয়ায় ঘেরা নগর জীবনের ধূসর পরিবেশ কবির কাছে ‘শীতের দুঃর স্বপ্নের মতো’ বলে মনে হয়েছে।
খ) এমন মনে হওয়ার কারণ :
মায়ের সঙ্গে সন্তানের যেমন নাড়ীর সম্পর্ক, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ঠিক তেমনি। মায়ের দেহ রস থেকেই সন্তান যেমন মাতৃগর্ভে পুষ্ট হয়, মানুষ তেমনি প্রকৃতির গর্ভে বেড়ে ওঠে এক নিরাপদ বলয়ের মধ্যে থেকে। কিন্তু মায়ের গর্ভের মতো এই প্রকৃতি যদি অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে, তবে মানুষের জন্য তা দুঃস্বপ্নের মত হয়ে দাঁড়ায়।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লব পুঁজিবাদী সমাজের কাছে মুনাফা লোটার হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ফলে শিল্প উন্নয়নের দানবীয় চেহারা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীময়। শিল্পের হাত ধরে দুর্বার গতিতে বেড়ে ওঠে নগরায়ন। ফলে শিল্প কারখানার ধুলো ও ধোঁয়ায় নগরের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে ওঠে। শীতকালে এই দূষণ ভয়ানক চেহারা নেয়। এই বিষাক্ত ধুলো ও ধোঁয়া শীতের শিশিরকে আশ্রয় করে ধোঁয়াশায় রূপ নেয় এবং তাতেই ভরে যায় চতুর্দিক। কবির কথায়,
ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস ঘুরে ফিরে ঘরে আসে
শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়া সেই ‘ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাসে’ কবির যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। শহর জীবনকে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। আর এ কারণেই কবির কাছে এই পরিবেশ ‘শীতের দুঃস্বপ্নের মতো’ বলে মনে হয়েছে।
গ) এই দুঃস্বপ্ন থেকে কীভাবে মুক্তি :
নাগরিক কবি এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন। খুঁজেছেন সেই অরণ্যভূমি, যেখানে কবির সারা দিনের ক্লান্তির উপরে ঝরে পড়বে মহুয়া-ফুল এবং নেমে আসবে মহুয়ার গন্ধ। কবির বিশ্বাস ছিল ‘মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ’ তাঁর এই স্বপ্নকে সাকার করে তুলবে। পথের দু'ধারে ছায়া ফেলে থাকা দেবদারু বৃক্ষের রহস্যময় শক্তির ছোঁয়ায় আর দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাসের মতো মায়াবী সুর রাত্রের নির্জন নিঃসঙ্গতাকে আলোড়িত করার মাধ্যমে এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি আসবে।
তাই নগর সভ্যতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে অনেক অনেক দূরে মেঘ-মদির মহুয়ার দেশের মহুয়ার ফুল ও গন্ধে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে ‘ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস’ ঘিরে থাকা দুঃস্বপ্নের ঘর থেকে তিনি মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন।
ঘ) সত্যিই মুক্তি পেয়েছিলেন?
মহুয়ার দেশে পৌঁছে কবি উপলব্ধি করেছেন এখানকার অরণ্য-জীবনেও লেগেছে বিপর্যয়ের ঢেউ। ধনতান্ত্রিক অর্থ-ব্যবস্থার আগ্রাসনে সেখানকার আদিম সমাজব্যবস্থা আজ প্রায় ধ্বংস হতে বসেছে। অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক শোভার বক্ষ চিরে নিবিড় অন্ধকারে তাই মাঝে মাঝেই ভেসে আসছে কয়লা খনির ‘গভীর’ ও ‘বিশাল’ শব্দ যা কবির কাছে অসহ্য লাগছে।
আবার শিশির ভেজা সবুজ সকালে উঠে তিনি বিস্মিত নয়নে দেখছেন, ধুলোর কলঙ্ক মাখা রাতজাগা শ্রমিকের দুঃস্বপ্ন পীড়িত, ক্লান্ত ও অবসন্ন মুখ নিয়ে মহুয়ার দেশ আজ ভারাক্রান্ত। কবির কথায়,
অবসন্ন মানুষের শরীরে দেখি ধুলোর কলঙ্ক,
ঘুমহীন তাদের চোখে হানা দেয়
কীসের ক্লান্ত দুঃস্বপ্ন।
এভাবে কবিতার প্রথম স্তবকে কবির রোমান্টিক ভাবনায় ‘মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ’ নাগরিক জীবনের যান্ত্রিকতা ও একঘেয়েমি থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখলেও, অচিরেই (দ্বিতীয় স্তবকে) তাঁর আশা ভঙ্গ হয়। কারণ, মহুয়ার দেশ কবির রোমান্টিক ভাবনার আড়ালে থাকা ‘অসহ্য নিবিড় অন্ধকারে’ ভরা এক দুঃস্বপ্নের দেশ হয়ে ধরা দেয়।
------------xx-----------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন