“আমি কি তাকাব আকাশের দিকে / বিধির বিচার চেয়ে?”
“আমি কি তাকাব আকাশের দিকে / বিধির বিচার চেয়ে?” |
খ) তিনি কোন্ বিচারের কথা উল্লেখ করেছেন?
গ) তাঁর মনে এই দ্বন্দ্বমূলক প্রশ্ন জাগার কারণ কী?
ঘ) তিনি বিধির বিচার প্রত্যাশা করেন না কেন?
ঙ) এই মন্তব্যের তাৎপর্য আলোচনা করো।
ক) কে, কোন্ প্রসঙ্গে কাদের উদ্দেশ্যে এই কথা বলেছেন?
কবি মৃদুল দাশগুপ্তের ‘ধানক্ষেত থেকে’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত অংশটি গৃহীত হয়েছে।
এই কবিতায় কবি দেখিয়েছেন, শিল্পের জন্য কৃষি জমি অধিগ্রহণ করার প্রতিবাদে কৃষি জমি রক্ষা কমিটি কৃষক আন্দোলনের ডাক দেয়। এই আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলার রাজনীতি। এক পর্যায়ে এই আন্দোলন ও তার পাল্টা আন্দোলন হিংসাশ্রয়ী রূপ নেয় । একের পর এক সাধারণ মানুষের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে থাকে বাংলা জুড়ে। কবি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কারও ভাই অথবা মেয়ের ছিন্নভিন্ন লাশ দেখে অন্তত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। সেই সঙ্গে এও লক্ষ্য করেন, নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশই এই নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদ না করে আশ্চর্যজনকভাবে নিরব থাকছেন। এই পরিস্থিতিতে সমাজ সচেতন ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন কবি এই নির্বিকার ও নীরব হয়ে থাকা সহ-নাগরিকদের বিবেকের কাছে এই প্রশ্ন করেছেন।
খ) তিনি কোন্ বিচারের কথা উল্লেখ করেছেন?
জমি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আলোচ্য সময়ে একের পর মানুষ নিখোঁজ হয়। পরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এই সব মানুষের ছিন্নভিন্ন শবদেহ উদ্ধার হয় জঙ্গল সহ নানান জায়গা থেকে। সামাজিক মূল্যবোধ ও সংবেদনশীল মনের অধিকারী কবির কাছে এই মৃত্যু জঘন্য অন্যায়। এই অন্যায়ের বিচারের কথাই কবি তার কবিতায় উল্লেখ করেছেন।
গ) তাঁর মনে এই দ্বন্দ্বমূলক প্রশ্ন জাগার কারণ কী?
কবি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন, এই জঘন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমাজের অধিকাংশ মানুষই নীরব থাকছেন। কবি এই নীরবতার কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। বোঝার চেষ্টা করেছেনএই মানুষগুলো কেন এবং কীভাবে ভাবে প্রতিবাদ না করে সমাজের এই অবক্ষয়কে মেনে নিচ্ছেন? কবির ভাবনায়, এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। তবে কি তারা বিধির কাছে বিচার দিয়েই নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন? কবির কথায়,
আমি কি তাকাবো আকাশের দিকে
বিধির বিচার চেয়ে?
বস্তুত নাগরিক সমাজের এভাবে নীরব থাকার কারণ খুঁজতে গিয়েই তার মনে এই দ্বন্দ্বমূলক প্রশ্ন জেগেছে।
ঘ) তিনি বিধির বিচার প্রত্যাশা করেন না কেন?
কবি মৃদুল দাশগুপ্ত একজন বাস্তববাদী চিন্তাবিদ। তার যুক্তিবাদী ও সংবেদনশীল মন বিধির বিচারের আশায় বসে থাকতে পারে না। আসলে তিনি বিশ্বাস করেন না যে, এভাবে অন্যায়ের বিচার সম্ভব। বিশ্বাস করেন না বলেই তিনি বিধাতার বিচারের আশায় বসে থাকতে পারেন না। সে কারণেই তিনি তাঁর কবিতায় স্পষ্ট করেছেন এই বলে যে,অমি তা পারি না।এভাবে কবি বিধাতার বিচারের প্রত্যাশা করেন না বলেই তিনি গর্জে উঠেছেন তাঁর কবিতায় :
....................যা পারি কেবল
সে-ই কবিতায় জাগে
আমার বিবেক আমার বারুদ
বিস্ফোরণের আগে।
ঙ) এই মন্তব্যের তাৎপর্য আলোচনা করো।
আসলে কবি মৃদুল দাশগুপ্ত একজন সৃষ্টিশীল কবি। যার মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের চাষ হয়। যুক্তিবাদদের আলোয় সে মূল্যবোধ অঙ্কুরিত হয় তারপর বেড়ে ওঠে। জন্ম নেয় এক সংবেদনশীল মন যা তাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বাধ্য করে। তাই তাঁর কলম দিয়ে নির্দ্বিধায় বেরিয়ে আসতে পারে নিহত ভাইয়ের শবদেহ দেখে ক্রুদ্ধ হওয়ার কাব্যিক বয়ান :নিহত ভাইয়ের শপদেহ দেখেনিখোঁজ মেয়ের ছিন্নভিন্ন হওয়া লাশ জঙ্গলে পাওয়ার খবর পেয়ে নির্দ্বিধায় বিধাতার বিচারের দায়িত্বকে উপেক্ষা করতে পারেন। বলতে পারেন,
না-ই যদি হয় ক্রোধ
কেন ভালোবাসা, কেন বা সমাজ
কিসের মূল্যবোধ!
আমি কি তাকাবো আকাশের দিকেসমাজের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে বাংলা মায়ের সন্তানের পাশে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে ঘোষণা করতে পারেন :
বিধির বিচার চেয়ে
সে-ই কবিতায় জাগে
আমার বিবেক, আমার বারুদ
বিস্ফোরণের আগে।
অর্থাৎ কবির কাছে তার কবিতা হল তাঁর বিবেক যা বারুদ হয়ে বিস্ফোরণ বা বিপ্লবের অপেক্ষায় দিন গুনছে।
এভাবে কবি সামাজিক দায়বদ্ধতার যে ছবি তৈরি করেছেন তার কবিতার মাধ্যমে তা শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে শিল্পী সত্তার চিরকালীন প্রতিবাদের ইঙ্গিত বহন করে। যেখানে বিধির বিধান কিম্বা বিচার একেবারেই আবশ্যিক নয়। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ালে মানুষের অন্যায়ের বিচার বা মুক্তি সম্ভব।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন