এমন সময় হঠাৎই এক সাহেবের লেখা পড়লাম।” — ২০২০
খ) তিনি কী লিখেছিলেন?
ক) ‘এমন সময়’ বলতে কোন্ পরিস্থিতির কথা বলা হয়েছে?
নাট্যকার শম্ভু মিত্র ‘বিভাব’ নাটকে দেখিয়েছেন গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে আছে ‘দুরন্ত অভাব’। তার ওপর, সরকার গ্রুপ থিয়েটার-এর কাছ থেকে খাজনা আদায় করে। ফলে, তারা চূড়ান্ত আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়।
নাট্যকার এই সংকট থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। একদিন একটি পুরনো সংস্কৃত নাটক থেকে এক অভিনব অভিনয় রীতির সন্ধান পান তিনি। এই অভিনয় রীতিতে মঞ্চের কোন প্রয়োজন নেই, দরকার নেই মঞ্চ সজ্জার, কিম্বা দরজা-জানলা, টেবিল-বেঞ্চ, সিনসিনারি ইত্যাদির। দরকার শুধু একটা প্লাটফর্ম, আর নাটক করার অদম্য ইচ্ছা।
কিন্তু তাঁর মনে সংশয় জন্মায় এই ভেবে যে, শহরের ইংরেজি জানা মানুষ এই রীতি গ্রহণ করবেন তো! কারণ, সাহেবরা যা মানে না, এরা তা গ্রহণ করে না। ঠিক এই সময় তিনি এক রুশ সাহেব, নাম আইজেনস্টাইন, যিনি কাবুকি নামক এক জাপানি নাট্যগোষ্ঠীর একটি অভিনব নাট্য-রীতির প্রশংসা সম্বলিত একটি লেখা লিখেছিলেন, তা হাতে পান। লেখাটা তিনি পড়েন এবং নিজের মনে জোর পান। ‘এমন সময়’ বলতে ঠিক সেই পরিস্থিতির কথা বলা হয়েছে, যে পরিস্থিতিতে তিনি রুশ চিত্র পরিচালকের লেখাটি হাতে পান।
খ) তিনি কী লিখেছিলেন?
রাশিয়ান চিত্রপরিচালক ও চিত্র সমালোচক আইজেনস্টাইন একদিন মস্কোয় জাপানের কাবুকি থিয়েটারের অভিনয় দেখেছিলেন। দেখার পর যে যে বিষয়গুলো তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল, তিনি তার বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন তাঁর লেখায়।
তিনি লিখছেন, এই নাটকে দেখা যাচ্ছে, মঞ্চে একজন নাইট ক্ষুব্ধ হয়ে দুর্গ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন এবং তিনি কতদূর চলে এলেন তা বোঝাতে ওই নাইট স্টেজের পিছন দিক থেকে গম্ভীরভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন। নাইটের পিছনে একটা মস্ত বড় দুর্গদ্বার তৈরি করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দুজন শিফটার। ‘নাইট’ যত দূরে চলে যাচ্ছেন, দুর্গদ্বারটা ক্রমশ তত ছোট করে দেখাচ্ছেন শিফটাররা। এভাবে বড় থেকে ক্রমশ ছোট উপকরণ ব্যবহার করে ‘নাইট’ কত দূরে এসে পড়েছেন সেটা বোঝানো হল।
এছাড়া এই নাটকে, কীভাবে দু’জন যোদ্ধা কাল্পনিক খাপ থেকে কাল্পনিক তলোয়ার বের করে তুমুল যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন — লিখেছেন তার বিবরণও। লিখেছেন, যুদ্ধের একটা পর্বে একজন যোদ্ধা কীভাবে মারা যাচ্ছেন। এই মৃত্যু দৃশ্য দেখানো হলো এভাবে — একবার তার হাতটা নড়ে উঠল, তারপর একটা পা তিরতির করে কেঁপে উঠল, মাথাটা দুবার নড়ে উঠলো, চোখটা দুবার ঘুরল, এবং সবশেষে তার জিভটা বেরিয়ে গেল। অর্থাৎ একজন যোদ্ধার মৃত্যু হল। আবার পরক্ষণেই দেখা গেল, মৃত যোদ্ধার সদ্য বিধবা স্ত্রী ঢুকে প্রবল কান্নাকাটি শুরু করছেন। এরপর মৃত যোদ্ধাটা সন্তর্পনে সেখান থেকে চলে গেল। আইজেনস্টাইন লিখছেন, এতে দর্শকেরা কিছুই মনে করলেন না। কারণ তাদের কাছে এই মুহূর্তে স্ত্রীর দুঃখটাই প্রধান।
এভাবে কোন উপকরণ ছাড়াই কেবল অঙ্গভঙ্গিসর্বস্ব অভিনয়ের মাধ্যমে নাটকের দৃশ্য কীভাবে বাস্তবসম্মত, বিশ্বাসযোগ্য এবং শিল্পসম্মত করে তোলা যায়, আইজেনস্টাইন সে-কথাই লিখেছেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন