“যা আর নেই, যা ঝড়-জল-মাতলার গর্ভে গেছে, তা-ই খুঁজে খুঁজে উচ্ছব পাগল হয়েছিল।” — ২০১৭
খ) সে পাগল হয়েছিল কেন?
গ) সে দিনের দুর্যোগের বর্ণনা দাও।
ঘ) দুর্যোগটি উচ্ছবকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?
ক) উচ্ছব কে?
প্রখ্যাত কথাকার মহাশ্বেতা দেবী রচিত ‘ভাত’ গল্প থেকে উদ্ধৃত অংশটি নেওয়া হয়েছে। এই গল্পের প্রধান চরিত্র উৎসব নাইয়া। সুন্দরবনের বাদা অঞ্চলে তার বসবাস। লেখাপড়া না জানা গ্রামীণ মানুষের উচ্চারণে এই উৎসব নামটাই ‘উচ্ছব’ নামে পরিচিত পেয়েছে। এই উৎসব নাইয়াই আসলে উচ্ছব।
খ) সে পাগল হয়েছিল কেন?
উৎসব নাইয়া সুন্দরবনের বাদা অঞ্চলের বাসিন্দা। দিন-আনা-দিন-খাওয়া নিম্নবর্গের মানুষ সে। যে বছর পোকায় বা কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ধান নষ্ট হয়, সে বছর সে ও তার পরিবারকে কখনও আধ পেটা, কখনও সিকি পেটা, আবার কখনও উপোস করে কাটাতে হয়। সেবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে উৎসব নাইয়া ঘর ও সংসার দুটোই হারিয়ে ফেলে। পরিবার পরিজন হারানোর শোকে দিশেহারা হয়ে সে পাগল-প্রায় হয়ে পড়ে। এক সময় খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়। এভাবে পরিজন হারানোর শোক ও অনাহারে থাকার কারণে উৎসব পাগলের মতো হয়ে পড়েছিল।
গ) সে দিনের দুর্যোগের বর্ণনা দাও।
উৎসব নাইয়া ওরফে উচ্ছব একজন গরীব খেটে খাওয়া মানুষ। কাঁচা মাটি ও মাঝখানে বাঁশের খুঁটি পুঁতে গড়ে তুলেছে সুন্দরবনের বাদা অঞ্চলে তার নিজস্ব ঘর। কারণ, পাকা বাড়ি তৈরির মতো আর্থিক সামর্থ্য ভূমিহীন উচ্ছবের নেই।
এই বাড়িতে থাকা অবস্থায় একদিন রাত্রে তুমুল ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। প্রচন্ড শীতে উৎসবের বউ ছেলে-মেয়েকে জাপটে-সাপটে ধরে ভয়ে কাঁপতে থাকে। উৎসব প্রাণপণে ঘরের মাঝখানের খুঁটিটি মাটিতে দাবিয়ে ঘরটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ঘরের মাঝখানের খুঁটিটি মাতালের মতো টলতে থাকে। যেন ধনুষ্টংকার রোগীর মত সে কেঁপেঝেঁকে উঠছিল। অসহায় মানুষের একমাত্র ভরসা ভগবানকে সে ডাকতে থাকে বারংবার। কিন্তু কোন সাড়া সেদিন মেলেনি। উৎসবের মনে হচ্ছিল, ভগবানও যেন শীতের এই দুর্যোগপূর্ন রাতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
এমন সময় মাতলা নদীর জল বাতাসের চাবুকের আঘাতে ছটফটিয়ে উঠে পড়েছিল উৎসবের ঘরের ওপর। মুহূর্তে তার ঘর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সকাল হতেই বোঝা গেল, শুধু ঘর নয়, সংসারটাও হারিয়ে ফেলেছে উচ্ছব।
ঘ) দুর্যোগটি উচ্ছবকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?
দুর্যোগের আকস্মিকতায় সাময়িকভাবে উৎসবের বুদ্ধি লোক পায়। বউ-ছেলেমেয়েকে ফিরে পাওয়ার আশায় ভেঙে পড়া ঘরের চালের সামনে পাগল প্রায় হয়ে বসে থাকে। মাঝে মাঝে সে বলে, “রা কাড় অ চ্ন্নুনির মা!” মাঝে মাঝে খুঁজে বেড়ায় টিনের তৈরি মুখ বন্ধ কৌটোটা, যেখানে সরকারের কাছে ভূমিহীন উৎসব জমি চেয়ে যে দরখাস্ত করেছিল, তার নকলটি রাখা ছিল। কথাকারের বর্ণনায়,
যা আর নেই যা ঝড় জল মাতলার গর্ভে গেছে তাই খুঁজে খুঁজে উৎসব পাগল হয়েছিল।
তাই সরকারের দেয়া রান্না খিচুড়ি তার আর খাওয়া হয়নি। যেদিন সংগীত ফিরল তখন আর খিচুড়ি নেই। শুধুই শুকনো চাল। অগত্যা উৎসব সেই চাল চিবিয়ে জল খেয়ে দিন কাটাতে থাকে। এই সময় মাঝে মাঝেই তার মনে পড়ে দুর্যোগের সেই রাতটার কথা। কিন্তু কোন কথা গুছিয়ে এসে ভাবতে পারেনা। মাথার ভিতরটা ঝিমঝিম করে। গুছিয়ে ভাবতে গেলে মনে পড়ে সতীশ মিস্ত্রির ধানে মড়ক লাগার কথা। কখনো কখনো তার মনে হয় দীর্ঘদিন ধরে ভাত না খেয়ে সে যেন ক্রেত হয়ে গেছে। পেট পুরে দুটো ভাত খেলেই সে পুনরায় মানুষ হয়ে উঠবে এবং বউ ছেলেমেয়েদের দুঃখে কাঁদতে পারবে। গুছিয়ে কথা বলতে পারবে। এসব সাতপাশ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে হল কলকাতায় গিয়ে কিছুদিন খেয়ে মেখে আসি। তার এই ভাবনা থেকে সে কলকাতায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন