‘নানা রঙের দিন’ নাটক অবলম্বনে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্র বিশ্লেষণ করো।
নানা রঙের দিন’ নাটকে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্র |
অথবা, |
‘নানা রঙের দিন’ নাটকে অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের যে নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্বের ছবি ফুটে উঠেছে তা আলোচনা করো।
ভূমিকা :
রুশ নাট্যকর অন্তন চেখভের ‘সোয়ান সং’ একাঙ্ক নাটক অবলম্বনে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করেন ‘নানা রঙের দিন’ নাটকটি। এই নাটকের মুখ্য চরিত্র রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় একজন আটষট্টি বছরের প্রবীণ অভিনেতা। নাটকটিতে দর্শকশণ্য অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে কখনো একা, আবার কখনো প্রম্পটার কালীনাথ সেনের সঙ্গে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রজনীকান্ত যে কথাবার্তা বলেছেন তা থেকেই তার চরিত্রের দুটি দিক উন্মোচিত হয়েছে। একটি ব্যক্তির রজনীকান্ত, অন্যটি অভিনেতা রজনীকান্ত।
ব্যক্তি রজনীকান্তের চরিত্র :
১) অভিনয় ছিল নেশার বস্ত :
ব্যক্তির রজনীকান্ত পারিবারিক সূত্রে রাঢ়বাংলার একজন ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। যৌবন বেলায় অভিনয় ছিল তার নেশার বিষয়। এই নেশার টানেই তিনি পুলিশের চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছিলেন।
২) ব্যক্তিগত জীবন উপেক্ষিত :
এই অভিনয়ের টানে তিনি তার ব্যক্তিগত জীবনকে দারুন ভাবে উপেক্ষা করেছিলেন। অভিনয়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসায় তিনি অবলীলায় ছিঁড়ে ফেলেছিলেন প্রেমিকার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত জীবনের বন্ধন।
৩) শেষ বয়সের একাকীত্ব :
কিন্তু পৌত্ততে পৌঁছে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ব্যক্তি মানুষ হিসেবে এটা ছিল একটি ভুল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ব্যক্তি জীবনকে উপেক্ষা করার জন্য তিনি আজ একজন নিঃস্ব, রিক্ত এবং একাকী মানুষ। তার এই উপলব্ধি প্রকাশ পেয়েছে তারই এক উক্তিতে, “মরবার সময় মুখে দু ফোটা জল দেয় এমন কেউ নেই আমার।”
অভিনেতা রজনীকান্তের চরিত্র :
১) অভিনয়ের প্রতি প্রগাড় প্রেম :
অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় শিল্পের জন্য আত্মনিবেদিত প্রাণ ছিলেন। প্রথম জীবনে তার মনে হয়েছিল, ‘নাট্যাভিনায় একটি পবিত্র শিল্প’। অভিনয়ের প্রতি প্রগাঢ় প্রেমের কারণেই তিনি যৌবনে শক্তি সম্ভ্রম প্রেম নারী সবকিছুকেই উপেক্ষা করেছেন।
২) খ্যাতির প্রতি প্রগারও টান :
নাটকের টানে তিনি সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ছেড়ে শিল্পকে একান্ত আপন করে নিয়েছিলেন। পেয়েছিলেন অসামান্য খ্যাতি। ‘রিজিয়া’, ‘সাজাহান’ সহ একের পর এক সফল অভিনয়ের কারণেই তার এই খ্যাতি।
৩) হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া :
কিন্তু জীবনের প্রান্ত সীমায় দাঁড়িয়ে তিনি উপলব্ধি করেন, নাট্যাভিনয় মোটেও ‘পবিত্র শিল্প’ নয়। ফলে একরাশ হতাশায় তিনি ডুবে যেতে থাকেন। বয়স বাড়ার কারণে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করার ডাক না পাওয়া, অভিনয়ের জন্য জীবন উৎসর্গ করা সত্ত্বেও তার সামাজিক স্বীকৃতি না পাওয়াই ছিল তার এই হতাশার কারণ।
৪) দ্বন্দ্বময় চরিত্রের অধিকারী :
একদিকে শূন্য জীবনের হাহাকার, অন্যদিকে প্রতিভার জোরে জোরা ব্যাধি মৃত্যুকে জয় করার উদগ্র বাসনা তার মধ্যে একই সঙ্গে জাগ্রত ছিল। এ কারণেই তাকে একদিকে বলতে শুনি নাট্যাভিনায় কোন পবিত্র শিল্প নয়, অন্যদিকে বলতে শুনি, শিল্পকে যে মানুষ ভালোবেসেছে তার বার্ধক্য নেই, একাকীত্ব নেই, নেই মৃত্যু ভয়ও।
এভাবে চরিত্রের এই দ্বান্দ্বিকতায় পড়ে তিনি একাধারে ঔরঙ্গজেবের মত ‘গ্লামিময়’ এবং ওথেলোর মত ‘সব হারানো ব্যক্তি’ হয়ে উঠেছেন। আর নাটকের শেষে তিনি বুঝেছেন, শিল্পের দায় অভিশপ্ত সিসিফাসের মতো তিনিও আমৃত্যু বহন করে চলেছেন, প্রতিভা দিয়ে যা বদল হবে না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন