পরিবেশ দূষণের কারণ ও তার প্রতিকার
পরিবেশ দূষণ ঃ
প্রাকৃতিক কারণে অথবা মানুষের কার্যকলাপে উদ্ভূত দূষিত পদার্থ পরিবেশকে বিষময় করে তোলে। পরিবেশের প্রাকৃতিক উপাদান, যেমন মাটি, পানি, বায়ু ইত্যাদির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈব পরিবর্তন ঘটে যা জীবজগতের উপর ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। এটিকে পরিবেশ দূষণ বলে।
পরিবেশ দূষণের কারণ ঃ
১। জনসংখ্যা বৃদ্ধি :
ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বনজঙ্গল কেটে বসতবাড়ি তৈরি করা হয়। ফলে বৃষ্টিপাত কমে, স্যানিটেশন ব্যবস্থাকে কলুষিত হয়, অধিক খাদ্য উৎপাদন করতে অধিক কীটনাশক ও সার ব্যবহার করতে হয়। ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়।
২। নগরায়ন :
নগরায়নের ফলে কলকারখানা ও গাড়ি বাড়ছে। ফলে কালো ধোঁয়া বায়ু দূষণের সৃষ্টি করছে। গাড়ির হর্ণ থেকে শব্দ দূষণ হচ্ছে। আবার নদীর পানিতে কলকারখানার আবর্জনা মিশে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে।
কাজের আশায় শহরে এলে বস্তি গড়ে উঠে। এই বস্তিতে বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন সমস্যা ও ময়লা-আবর্জনা ফেলার অব্যবস্থা ও সচেতনতার অভাব পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে।
৩। জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট সমস্যা :
সমগ্র বিশ্বে জলবায়ুর পরিবর্তনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। কারণ গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দুই মেরুর বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে।
এছাড়া খরা, নদীর প্রবাহ হ্রাস, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, পানযোগ্য জলের অভাব, মৎস্যসম্পদ ধ্বংস, ফসল উৎপাদন হ্রাস, ভূমিকম্প ইত্যাদি ভয়াবহ দুর্যোগে মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
৪। বনজ সম্পদ ধ্বংস :
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় একটি দেশের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু নগরায়ণ, শিল্পায়ন, জ্বালানি সংগ্রহ ও কৃষিজমি সম্প্রসারণের ফলে, জ্বালানি, বাড়িঘর, আসবাবপত্র নির্মাণ ইত্যাদি প্রয়োজনে ব্যাপকহারে বনজ সম্পদ উজাড় হচ্ছে। ফলে ভূমিক্ষয় হয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
৫। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন :
অপরিকল্পিতভাবে শিল্পায়ন, যেমন খাদ্যসামগ্রী তৈরির কারখানার পাশে সার ও কীটনাশক তৈরি কারখানা হলে পানি ও বায়ু দূষণ ঘটে। জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ে।
৬। অপরিকল্পিত বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন :
শিল্পকারখানা, আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশনের ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে সেগুলো মাটিতে শোষিত হচ্ছে বা পার্শ্ববর্তী জলাধারে গিয়ে পড়ছে, ফলে মাটি ও জল দূষিত হচ্ছে।
৭ । নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট :
নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট হওয়ার ফলে বৃষ্টির পানি সরে যেতে পারে না, জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, ফলে পরিবেশ দূষিত হয়।
৮। ইটভাটা :
নগরায়নকে কেন্দ্র করে কোনো নিয়মনীতি ছাড়া এদেশে অসংখ্য ইটভাটা গড়ে উঠেছে, যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। ইটভাটায় কাঠ ব্যবহারের ফলে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে এবং ইট পোড়ানোর ফলে বায়ুতে নির্গত বিষাক্ত গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৯। অচল ও অধিক যানবাহন ব্যবহার :
অচল ও অধিক যানবাহন ব্যবহারের ফলে অধিক জ্বালানি ব্যবহৃত হলে বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ সৃষ্টি হয়।
১০। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার :
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে গিয়ে কৃষি কাজে অপরিকল্পিতভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার হচ্ছে, ফলে মাটি ও বায়ুদূষণ ঘটছে।
১১। ভূমি ক্ষয় :
নগরায়ন, পাহাড় কাটা, জলাশয় থেকে নুড়ি-বালু, পাথর উত্তোলন, বনজ সম্পদ ধ্বংস ইত্যাদি কারণে ভূমিক্ষয় হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে পরিবেশ দূষণের সৃষ্টি হচ্ছে।
পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ ঃ
নিচে পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধের সম্ভাব্য উপায়সমূহ উল্লেখ করা হলো।
১। জোরালো প্রচার :
দেশের আপামর জনসাধারণকে পরিবেশ দূষণের কারণ ও তার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সজাগ করার জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে, যেমন- রেডিও-টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সেমিনারের মাধ্যমে জোরদার প্রচার চালানো।
২। পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তি :
শিক্ষার মাধ্যমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে 'পরিবেশ দূষণ'কে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সরকারিভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
৩। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড :
দেশের প্রতিটি প্রশাসনিক ইউনিটে 'পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড গঠন করে সামাজিক সংগঠনসমূহ যাতে প্রতি মাসে অন্তত একটি সেমিনার আয়োজন করে সচেতনতা বারান দরকার।
৪। জমি জরিপ শিল্পের অনুমোদন:
দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রাক্কালে যথাযথ জরিপ ও উপযোগিতা যাচাইয়ের মাধ্যমে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সুপারিশ গ্রহণের বিধান বাধ্যতামূলক করা।
৫। জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা :
জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশের সর্বত্র স্বাস্থ্যকর্মীদের ভূমিকার জন্য এদের কার্যকলাপের মূল্যায়ন সাপেক্ষে উৎসাহজনক পুরস্কারের ব্যবস্থা করা।
৬। বৃক্ষরোপণ ও বন সংরক্ষণ :
পরিবেশ দূষণের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার সর্বোত্তম হাতিয়ার হচ্ছে দেশের সর্বত্র প্রচুর গাছপালা লাগানো ও বনভূমির নির্বিচার নিধন রোধে আইন প্রণয়ন ও তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ।
৭। আবাসিক এলাকার বাইরে শিল্প :
নগরীর আবাসিক এলাকার বাইরে শিল্প কারখানা স্থাপন করা গেলে এই সমস্যার অনেকাংশে সমাধান পাওয়া যাবে।
৮) বস্তিবাসীর পুনর্বাসন:
সর্বোপরি বস্তি এলাকার অধিবাসীদেরকে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পুনর্বাসন করতে হবে, তা না হলে শহর ও নগরসমূহ দূষণমুক্ত হবে না।
৯। দূষিত পদার্থের নিরপেক্ষকরণ :
বায়ুদূষণ হতে পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে দূষিত পদার্থ নির্গত হওয়ার সময় এতে এমন পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে দিতে হবে যাতে এরা বায়ুকে দূষিত করার পূর্বেই নিরপেক্ষ (neutral) হয়ে যায়। জাপান এসিড বৃষ্টি প্রতিরোধকল্পে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে সফলতা লাভ করেছে।
১০। ধোঁয়া রোধক যন্ত্র :
সীসামুক্ত পেট্রোল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, মটরযানে নির্গত ধোঁয়া ও বিকট শব্দের জন্য নিরোধক যন্ত্র লাগান দরকার। এভাবে হাইড্রলিক হর্ণের পরিবর্তে শব্দ দূষণরোধে মিউজিক হর্ণ ব্যবহার করলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে।
১১। কৃষিতে জৈবিক পদ্ধতি প্রয়োগ :
পানিকে দূষণের হাত হতে রক্ষা করার জন্য ফসল ক্ষেতে কীটনাশক ও আগাছানাশক ঔষধের ব্যবহার কমিয়ে জৈবিক (Biological) পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
১২। পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার উন্নতি :
দেশের নগরসমূহের পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, পৌর আবর্জনা ও জঞ্জাল স্থানান্তর এবং পরিষ্কারের জন্য আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগ, শহর এলাকার নালা-নর্দমার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি কড়াকড়ি আরোপ ও নজরদারীর জন্য পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা যায়।
ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা ঃ
দূষণমুক্ত পরিবেশ রক্ষায় ছাত্র সমাজ ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিম্নলিখিত করণীয় বিষয়ে পরিবারকে নির্দেশনা দিতে পারে :
ক) ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণ :
১. পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা। পরিবারের প্রতিদিনের বর্জ্য বা ময়লা যেন পরিবেশ দূষণ না করে, এ ব্যাপারে পরিবারের সদস্যদের সচেতন করতে হবে।
২. প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ
৩. ক্ষতিকর সিনথেটিক বর্জন। যেসব আবর্জনা বিনষ্ট হয় না তা কম ব্যবহার করা। যেমন-প্লাস্টিকের ব্যাগ
৪. নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার
৫. উন্নয়ন ও দূষণমুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার। মশা, মাছি, ইঁদুর, তেলাপোকা নিধনে ডি.ডি.টি পাউডার, কয়েল, এ্যারোসোল ইত্যাদির ব্যবহার কমাতে হবে। রাসায়নিক দ্রব্য কম ব্যবহার করা।
৬. গাছ লাগানো। বাড়ির আশেপাশের পরিবেশ যেন ঠিক থাকে সেজন্য ছোট বড় গাছপালা রোপণ করতে হবে।
৭. টেলিভিশন ও ক্যাসেট প্লেয়ার জোরে না বাজানো
৮) পরিকল্পিত পরিবার গড়ে তুলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে হবে।
৯) নিজের চাওয়াকে ত্যাগ করে সমাজের কল্যাণকে গুরুত্ব দেয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। ধূমপানের অভ্যাস না করা।
১০) পরিবারে গাড়ি থাকলে অবশ্যই দৃষ্টি রাখতে হবে যেন গাড়ি থেকে কালো ধোঁয়া নির্গত না হয়।
১১) সর্বোপরি দূষণমুক্ত পরিবেশ রক্ষার সুষ্ঠুনীতি ও আইন ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে।
সমষ্টিগত উদ্যোগ গ্রহণ :
উপরোক্ত বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ছাত্র সমাজ সমষ্টিগতভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে।
এই সব বিষয়ে ১) আলোচনা সভা, ২) পথনাটিকা, ৩) ব্যানার ও পোস্টার লাগানো, ৪) বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রচার চালানো, নিজ নিজ বিদ্যালয় পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য নির্মল বিদ্যালয় প্রকল্পে অংশগ্রহণ ইত্যাদি।
উপসংহার :
সুতরাং স্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিবেশ বিষয়ে শিক্ষা ও জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ হল গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের বিশেষ করে ছাত্র সমাজের মধ্যে যথাযথ সচেতনা সৃষ্টি ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। সরকার ও জনগণের মিলিত প্রচেষ্টায় পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ কার্যক্রম সফল হওয়া সম্ভব।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন