প্রবন্ধ রচনা : মৃণাল সেন
ভূমিকা :
মৃণাল সেন ছিলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও লেখক। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে এক বন্ধনীতে উচ্চারিত হতো তার নামও।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন :
মৃণাল সেন ১৯২৩ সালের ১৪ মে বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্ম । এখানেই তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন। এর পর তিনি কলকাতায় চলে আসেন। পদার্থবিদ্যা নিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশোনা করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
প্রাথমিক কর্ম :
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে তিনি সাংবাদিকতা, ওষুধ বিপণনকারী হিসাবে কাজ শুরু করেন। চল্লিশের দশকে মৃণাল সেন ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর চলচ্চিত্রে শব্দকুশলী হিসেবেও কাজ শুরু করেন।
রাজনৈতিক দর্শন :
আজীবন বামপন্থায় বিশ্বাসী মৃণাল সেন দীর্ঘদিন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে রাষ্ট্রপতির মনোনীত সদস্য হিসেবে ভারতের পার্লামেন্টের সদস্য হন।
ছবি পরিচালনা :
বাংলা, ওড়ইয়আ, হিন্দি এবং তেলেগু ভাষায় চলচ্চিত্র পরিচালনা করে তিনি বহুভাষিক চিত্র পরিচালক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
বাংলা চলচ্চিত্রে মৃণাল সেন :
১৯৫৫ সালে মৃণাল সেন চলচ্চিত্র পরিচালনায় হাত দেন। তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি ‘রাতভর’। তবে ছবিটি বেশি সাফল্য পায়নি। তার দ্বিতীয় ছবি ‘নীল আকাশের নিচে’। এই ছবিটি তাঁকে স্থানীয় পরিচিতি এনে দেয়। ‘বাইশে শ্রাবণ’ এনে দেয় আন্তর্জাতিক পরিচিতি।
১৯৬৯ সালে ‘ভুবন সোম’ মুক্তি পায়। এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা উৎপল দত্ত । অনেকের মতে এটা ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠ ছবি।
মৃণাল সেন তার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তৎকালীন কলকাতার অস্থির অবস্থাকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর ইন্টারভিউ, ক্যালকাটা ৭১, ও পদাতিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মধ্যবিত্ত সমাজের নীতিবোধকে তুলে ধরেছেন ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯) এবং ‘খারিজ’ (১৯৮২)-এর চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ‘খারিজ’ ১৯৮৩ সালের কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছিল।
১৯৮০ সালে পরিচালনা করেন ‘আকালের সন্ধানে’। কীভাবে ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের কাল্পনিক কাহিনী মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সেই গ্রামের সাধারণ মানুষদের সঙ্গে — সেটাই ছিল এ চলচ্চিত্রের সারমর্ম। ‘আকালের সন্ধানে’ ১৯৮১ সালের বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার হিসেবে রুপার ভালুক জয় করে।
মৃণাল সেনের পরবর্তীকালের ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৯২) এবং ‘অন্তরীণ’ (১৯৯৪)। তাঁর শেষ ছবি ‘আমার ভুবন’ মুক্তি পায় ২০০২ সালে।
ভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্রে মৃণাল সেন :
১৯৬৬ সালে উড়িয়া ভাষায় নির্মাণ করেন ‘মাতিরা মানিশা’, যা কালীন্দিচরণ পাণিগ্রাহীর গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়। ১৯৬৯-এ বনফুলের কাহিনী অবলম্বনে হিন্দি ভাষায় নির্মাণ করে ‘ভুবন সোম’। ১৯৭৭ সালে প্রেম চন্দের গল্প অবলম্বনে তেলেগু ভাষায় নির্মাণ করেন ‘ওকা ওরি কথা’। ১৯৮৫ সালে নির্মাণ করেন ‘জেনেসিস’- যা হিন্দি, ফরাসি ও ইংরেজি তিনটি ভাষায় তৈরি হয়।
সম্মাননা প্রাপ্তি :
ভারত এবং ভারতের বাইরের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে।
দেশের পুরস্কার ও সম্মাননা :
১৯৯৩ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট পদকে ভূষিত করে। ১৯৯৬ ও ১৯৯৯ সালে যথাক্রমে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে একই সম্মান জানান। পদ্মভূষণ, দাদাসাহেব ফালকেসহ নানাবিধ পুরস্কার রয়েছে পরিচালক মৃণাল সেনের ঝুলিতে।
বিদেশি পুরস্কার ও সম্মাননা :
২০০০ সালে রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁকে গার্ড অব ফ্রেন্ডশিপ সম্মানে ভূষিত করেন। তিনি ইন্টারন্যাশন্যাল ফেডারেশন অফ দি ফিল্ম সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফরাসি সরকার তাকে কম্যান্ডার অফ দি অর্ডার অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস (Ordre des Arts et des Lettres ) সম্মানে সম্মানিত করেন। এই সম্মান ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান।
তাঁর সাহিত্য কীর্তি :
চিত্র পরিচালনা ছাড়াও চলচিত্র বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন।
গ্রন্থতালিকা :
জনৈকের জীবনচরিত (১৯৪৬, নিউ এজ) - অনুবাদক
চার্লি চ্যাপলিন (১৯৫৩, নিউ এজ)
ভিউস অন সিনেমা (১৯৭৭, ইংরেজি)
সিনেমা, আধুনিকতা (১৯৯২, প্রতিক্ষণ প্রকাশনী)
মন্টেজ: লাইফ, পলিটিক্স, সিনেমা (২০০২, ইংরেজি, সীগাল বুক্স)
অলোয়েজ বিইঙ্গ বর্ন (২০০৪, ইংরেজি, স্টেলার পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড)
চিত্রনাট্য :
দ্য রুইন্স (১৯৮৪, ইংরেজি, সীগাল বুক্স)
অকালের সন্ধানে (১৯৮২, বিভব)
ইন সার্চ অব ফেমিন (১৯৮৫, ইংরেজি, সীগাল বুক্স)
অন্তরীণ (১৯৯৭, বিতর্ক)
দ্য অ্যাবসেন্স ট্রিলজি (১৯৯৯, সীগাল বুক্স)
চিত্রনাট্য (২০০৪, পুনশ্চ)
আমার ভুবন (২০০৪ , দে'জ পাবলিশিং)
পরলোক গমন :
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর এই কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার পরপারে পাড়ি জমান। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর।
-----------xx----------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন