বিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনস্কতা ও কুসংস্কার
বিজ্ঞান কী?
ল্যাটিন শব্দ ‘সায়েন্টিয়া’ থেকে ইংরেজি ‘সায়েন্স’ শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান। বাংলা ভাষায় ‘বিজ্ঞান’ শব্দটির অর্থ ‘বিশেষ জ্ঞান’। প্রকৃত অর্থে, বিজ্ঞান হল প্রকৃতি সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞান, যা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পাওয়া যায়। যার ভিত্তিতে প্রাকৃতিক ঘটনাকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা যায়। এবং যা প্রয়োগ করে কোনো বিষয় সম্পর্কে প্রকৃত সত্যে পৌঁছানো যায়।
বিজ্ঞানমনস্কতা কী?
বিজ্ঞানমনস্কতা হল এক বিশেষ মানসিকতা যা প্রচলিত বিশ্বাসকে সরিয়ে রেখে মানুষকে যুক্তি, বুদ্ধি ও তথ্য দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রকৃত সত্যে পৌঁছাতে উৎসাহিত করে। সত্যে পৌঁছানোর এই পদ্ধতিকে বলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।
বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার উৎপত্তি :
মানব সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই কিছু মানুষ পার্থিব নানা জটিল সমস্যার সমাধানকল্পে বিশ্বাসের পরিবর্তে কার্যকারণ সম্পর্ককে আশ্রয় করে। অর্থাৎ প্রকৃতিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করে। এদের হাত ধরেই জন্ম নেয় বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতা।
বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার পার্থক্য :
বিজ্ঞানের সঙ্গে বিজ্ঞানমনস্কতার গভীর পার্থক্য রয়েছে।
১) বিজ্ঞান সম্পূর্ণভাবে নৈর্ব্যক্তিক কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতা প্রচন্ডভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক।
২) বস্তুকে নিয়েই বিজ্ঞানের কারবার। বস্তুর কোন জাত ধর্ম নাই। তাই বিজ্ঞানেরও কোন জাত ধর্ম থাকে না। কিন্তু মানুষের মন তথা চিন্তা ভাবনা জাত-ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই তাকে কেন্দ্র করেই নিয়ন্ত্রিত হয় মানুষের বিজ্ঞান চিন্তা বা বিজ্ঞানমনস্কতা।
৩) বিজ্ঞান প্রকৃতি ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্তর্নিহিত নিয়মাবলী খুঁজে বার করতে চায়, তার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কী তা নির্ণয় করতে চায়। আর মানুষের বিজ্ঞানমনস্ক মন তাকে এই কাজে অংশ নিতে উৎসাহিত করে।
কুসংস্কার কী?
কুসংস্কার হল এক ধরনের প্রচলিত বিশ্বাস। এই বিশ্বাসকে ভর করে সাধারণ মানুষ প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করে। প্রকৃতির রোষ থেকে বাঁচার উপায় বের করে, যেখানে কার্যকারণ সম্পর্কের ভীত থাকে বিশ্বাসের উপর ভর করে। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে তা যাচাই বাছাই করার প্রক্রিয়া অনুপস্থিত থাকে।
সংস্কার ও কুসংস্কারের উৎপত্তি :
মনুষ্য সৃষ্টির আদিকাল থেকেই দুঃখ, কষ্ট, মৃত্যু, রোগভোগ নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। ফলে আদিকাল থেকেই তারা এর কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। উপায় খুঁজেছে কীভাবে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
কিছু মানুষ এ সমস্ত কিছুর পেছনে কোন অশুভ শক্তির কারসাজির কথা অনুমান করেছেন। ভেবেছেন তাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। মানুষের এই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নিয়েছে কিছু আচার বিচার ও নিয়ম-কানুন। যার ভিত্তি কোন কার্যকারণ সম্পর্ক নয়। এভাবেই জন্ম নিয়েছে সংস্কার। যারা এগুলো মেনে চলে তারা সংস্কারাচ্ছন্ন কিংবা কুসংস্কারাচ্ছন্ন।
কুসংস্কারের প্রকারভেদ :
কুসংস্কারকে আমরা মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। যথা, ব্যক্তিগত, সামাজিক ও ধর্মীয়।
ব্যক্তিগত কুসংস্কার :
ব্যক্তিগত কুসংস্কার প্রধানত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ব্যক্তি বিশেষে তা ভিন্ন হয়। যেমন, পরীক্ষার দিনে কেউ ডিম, কেউ রসগোল্লা, কেউবা কলা খায় না। যাত্রার মায়ের পিছনে ঢাকা অমলজনক ইত্যাদি ব্যক্তিগত কুসংস্কারের মধ্যে পড়ে।
সামাজিক কুসংস্কার :
সামাজিক কুসংস্কারের অন্যতম উদাহরণ হল ডাইনি, সুলক্ষণা, কুলক্ষণা সংক্রান্ত ধারণা। এখনো পর্যন্ত আমাদের দেশে ডাইনি সন্দেহে মানুষকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটে।
ধর্মীয় কুসংস্কার :
ধর্মীয় কুসংস্কার বলতে সেইসব কুসংস্কারকে বোঝায় যেগুলোর সঙ্গে ধর্মের যুগ রয়েছে। একদা প্রচলিত সতীদাহ প্রথা, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি ধর্মীয় কুসংস্কারের উদাহরণ।সংস্কার ও কুসংস্কারের পার্থক্য :
যে সমস্ত আচার বিচার মানুষের মানসিক শক্তিকে বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু কোন ক্ষতি করে না, সেগুলোকে বলা হয় সংস্কার। অন্যদিকে যা মানুষের জীবনে ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়ায় তাকে বলা হয় কুসংস্কার।
কুসংস্কার ও বিজ্ঞানমনস্কতার সম্পর্ক :
কুসংস্কার মূলত এক ধরনের বিশ্বাস। যার ভেতর কোনো যুক্তি কাজ করে না। অন্যদিকে, বিজ্ঞানমনস্কতা যুক্তি ও তথ্যনির্ভর এবং বিচার-বিশ্লেষণ এর আবশ্যিক শর্ত। তাই এই দুইয়ের সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক। কোনো ব্যক্তি যত বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠে, তার মধ্যে কুসংস্কার তত কমতে থাকে। আর বিজ্ঞানমনস্কতা কমতে থাকলে কুসংস্কার বাড়তে থাকে।
কুসংস্কার দূরীকরণে বিজ্ঞানমনস্কতার ভূমিকা :
সংস্কার যতটা ক্ষতিকারক, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ক্ষতিকারক কুসংস্কার। কারণ, কুসংস্কার বহু ক্ষেত্রেই অমানবিক প্রথার জন্ম দেয় এবং মানুষের জীবনকে বিপজ্জনক আবর্তে ঠেলে দেয়। ফলে সমাজ পিছিয়ে পড়ে।
এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র বিজ্ঞান ও মানুষের বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনা ও চিন্তা। তাই সমাজে এই দুইয়ের প্রচার ও প্রসার খুবই জরুরী। কারণ, একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষই কেবল বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে বিষধর সাপে কাটা রোগীকে অ্যান্টি ভেনাম দিয়ে বাঁচিয়ে তুলতে পারে।
কুসংস্কার দূরীকরণ ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচারে ছাত্র সমাজের ভূমিকা :
হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে বেড়ানো কুসংস্কার থেকে মানুষকে মুক্ত করা কঠিন কাজ। তবে বিজ্ঞানমনস্ক ছাত্র সমাজ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।
১) কুসংস্কার কী, তা কীভাবে মানুষের ক্ষতি করে, সমাজকে পিছিয়ে দেয়, একজন ছাত্র তা নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে।
২) দলগতভাবে নিজ নিজ এলাকায় বাড়ি বাড়ি প্রচার করতে পারে।
৩) স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যারা বিজ্ঞান চেতনার বিকাশে কাজ করে, তাদের দিয়ে আলোচনা সভা ও কুসংস্কার বিরোধী প্রদর্শনীর আয়োজন করতে পারে।
৪) পথসভা, পথনাটিকা করতে পারে।
৫) পোস্টার, ফেস্টুন, প্লাকার্ড নিয়ে শোভাযাত্রা, মিছিল ইত্যাদির মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করতে পারে।
উপসংহার :
বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার সঙ্গে কুসংস্কারের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। বিজ্ঞানমনস্কতাকে হাতিয়ার করে বিজ্ঞানকে গ্রহণ করতে পারলেই কুসংস্কারকে অতিক্রম করা যায়। মানব সমাজকে উন্নততর জীবন ব্যবস্থা উপহার দেওয়া সম্ভব হয়। তাই বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারে ছাত্র সমাজের পাশাপাশি, আমজনতা এবং বিশেষ করে সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। স্কুলের পাঠক্রমে বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারের সহায়ক হয় এমন বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে জোর দিতে হবে। তবেই আমাদের দেশ সত্যিকারে উন্নত ও প্রগতিশীল হয়ে উঠবে। জগত সভায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন