অরণ্য, অরণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ, ও মানব জীবন
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লৌষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা!
ভূমিকা :
৩ মার্চ বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস। ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৮তম অধিবেশনে ৩ মার্চকে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ২০২৩ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্য প্রাণীকুল বাঁচাই’। বিশ্বের বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদকুলের প্রতি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করাই হল এই দিবসের মূল লক্ষ্য।
অরণ্য ও মানব জীবন :
সৃষ্টির শুরু থেকেই অরণ্য ছিল মানুষের পরম আত্মীয়, অকৃত্রিম বন্ধু । অরণ্যই দিয়েছে মানুষকে বেঁচে থাকার রসদ। নানা রকম ফলমূল সহ পরিবেশে অক্সিজেন সরবরাহ করে, বাতাসে জলীয় বাষ্প প্রদান ও কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে মানব জীবনকে দিয়েছে সুরক্ষা। শুধু তাই নয়, অনেক জীবের বাসস্থানরূপেও কাজ করে আসছে এই অরণ্য। তাই গাছ কাটা হলে, পরিবেশের ভারসাম্যের পাশাপাশি বাস্তুতন্ত্রও ব্যাহত হয়।
সুতরাং অরণ্য ধ্বংস মানেই বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায়। আর এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি। এছাড়াও বন্যা,খরা ও ভুমিক্ষয় বেড়ে যাওয়া। কারণ, এগুলো রোধে অরণ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অরণ্যপ্রাণী কারা :
গৃহপালিত প্রাণী ছাড়া বনে বসবাসরত সব প্রাণীই বন্যপ্রাণীর অন্তর্ভুক্ত। দেয়ালের টিকটিকি থেকে শুরু করে আঙ্গিনায় বিচরণকারী কাক, চড়ুইও বন্যপ্রাণী। বন হল বন্যপ্রাণীর আবাস। ক্রমাগত বন ধংসের ফলে বন্যপ্রাণী খাদ্য সংগ্রহ আর আশ্রয়ের খোঁজে লোকালয়ে এসে পড়ে আর মানুষের হাতে প্রাণ হারায়।
অরণ্য ও অরণ্যপ্রাণী ধ্বংসের কারণ :
সামান্য মৌসুমি ফল রক্ষায় মানুষ আজ কারেন্ট জাল বিছিয়ে রাখে আর তাতে জড়িয়ে প্রাণ হারায় নিরীহ পাখিরা। ক্ষতিপূরণের বিধান থাকা সত্ত্বেও গুটিকতক বুনোহাতির কবল থেকে ফসল রক্ষা করতে বিদ্যুতের ফাঁদ পাতা হয়। ফলে, তাতে জড়িয়ে প্রাণ হারায় বুনোহাতি। কতটুকু অসহায় হলে বন্যপ্রাণী লোকালয়ে হানা দেয়, তা মানুষের অনুধাবন করা উচিত।
কিছু মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষ আছে, যাদের হাজাররকম খাবার বাদ দিয়ে নজর পড়ে বন্যপ্রাণীর দিকে। আর তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য ঘৃণিত ও আইনবহির্ভূত পেশা বেছে নিয়েছে কিছুসংখ্যক শিকারি। কিছু মানুষের আবার আছে বন্যপ্রাণীর দেহাংশ সংগ্রহ করে শো-পিস হিসেবে প্রদর্শন করার অভ্যাস। ফলে লাগামহীনভাবে ধ্বংস হচ্ছে অরণ্য ও অরণ্য প্রাণী।
অরণ্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা :
প্রকৃতির সবকিছুই পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। কখনো তা প্রত্যক্ষভাবে, আবার কখনো পরোক্ষভাবে। আর এ কারণে কোন এক জীব গোষ্ঠী অবলুপ্ত হলে তার কুপ্রভাব পড়ে অন্যান্য জীবের উপর। সুতরাং বন্যপ্রাণী বা বন যে মানব জীবনের উপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলে — একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মানুষের অপরিকল্পিত পদক্ষেপের কারণে ইতিমধ্যেই উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির এক বিরাট অংশ হারিয়ে গেছে প্রকৃতি থেকে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে ইতিমধ্যেই। বিশ্ব উষ্ণায়নসহ নানা প্রকৃতিক দুর্যোগ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এর সর্বশেষ সংযোজন নতুন নতুন প্রাণঘাতী রোগের মহামারী।
মনে রাখতে হবে, এখনও প্রতিদিন উজাড় হচ্ছে প্রায় ২ লাখ একর বন আর মারা পড়ছে ১৫০-২০০ প্রজাতির বন্যপ্রাণী! অরণ্য ধ্বংস হলে বন্যপ্রাণী অনন্যোপায় হয়েই লোকালয়ে আসে খাদ্য সংগ্রহ করতে। পরিণতিতে মানুষ ও বন্য প্রাণী উভয়েরই জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
এই অবস্থা থেকে বের হতে হলে আমাদের বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরী কর্তব্য হিসেবে গণ্য করতে হবে। বস্তুত এ কারণেই বিশ্বের বিবেচক মানুষরা আজ সোচ্চার বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে।
আরণ্যপ্রাণী সংরক্ষণের উপায় :
অরণ্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য নিম্নলিখিত কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত —
১) বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় বিশ্বের সব নাগরিককে সোচ্চার আর সচেতন হতে হবে। যেখানেই বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত অপরাধ সংঘটিত হবে সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে স্থানীয়দের। অপরাধীদের সংখ্যা খুবই অল্প।
২) নতুন প্রজন্মকে বন্যপ্রাণী ও পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে কাজটা খুব সহজ হবে আর ভবিষ্যৎ পৃথিবী হবে নিরাপদ। সে জন্য প্রয়োজন প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সম্পর্কিত কারিকুলাম।
৩) শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের গল্প, উপন্যাস, ছড়া হোক পরিবেশ ও প্রকৃতিবান্ধব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হোক পরিবেশ ও প্রকৃতিবান্ধব।
৪) প্রতিটি দেশে গড়ে তুলতে হবে অন্তত একটি করে প্রকৃতি বিশ্ববিদ্যালয়। তাহলেই আমরা পাব জীববৈচিত্র্যবান্ধব দেশ এবং নিরাপদ পৃথিবী।
৫) একটা গাছ কাটলে, তার বিনিময়ে অধিক সংখ্যক গাছ লাগাতে মানুষকে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।
অরণ্য ও অরণ্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব :
সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতিকে সাজিয়েছেন বন্যপ্রাণী, উদ্ভিদ আর পরিবেশের অন্যান্য উপাদান দিয়ে। একেকটা বন্যপ্রাণী যেন একেকটা পুঁতি। পুঁতির মালা ছিন্ন হলেই যেমন পুঁতিরা বিপন্ন হয়ে পড়ে, তেমনি ভারসাম্য হারায় প্রকৃতি।
এরই প্রতিশোধ হিসেবে প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানছে। বজ্রপাত, সুনামি, সুপারসাইক্লোনসহ নানারকম প্রকৃতিক দুর্যোগ সময়ে-অসময়ে হানা দিয়ে জীবন-জীবিকা তছনছ করে দিচ্ছে। এছাড়া নির্বোধদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে এসেছে নিপাহ্, করোনার মতো ভাইরাস।
উপসংহার :
সুদূর অতীতে বন্যপ্রাণী থাকত বনে, লোকচক্ষুর আড়ালে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের নিজেদের জটিল কিছু রোগ ব্যাধি থেকে মানুষ দূরে থাকতো, থাকতো সুরক্ষিত। কিন্তু কিছু মানুষের বিকৃত খাদ্যাভ্যাসের কারণে এবং বন্য প্রাণীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে ব্যবসা করার তাগিদে তাদের সান্নিধ্যে আসছে প্রতিনিয়ত। ফলে নিরাময় অযোগ্য এসব রোগ মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ছে। তাই মানব জাতিকে বাঁচাতে হলে, বন্যপ্রাণীকে সংরক্ষণ করতে হবে, লোকালয় থেকে দূরে রাখতে হবে। আর সংরক্ষণ করতে দরকার সুরক্ষিত বন বা অরণ্য। সুতরাং অরণ্য ও অরণ্য প্রাণী সংরক্ষণের বিষয়টির সঙ্গে মানব জীবনের সম্পর্ক গভীরভাবে সম্পর্কিত।
---------xx---------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন