ছাত্র জীবনের সৌজন্য ও শিষ্টাচার
মানব জীবনে শিষ্টাচার, ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ভদ্রতা আত্মীয়তার চেয়ে কিছু কম এবং সামাজিকতার চেয়ে কিছু বেশি।
ভূমিকা?
ইংরেজীতে যাকে বলে Etiquette; good manners; formality; বাংলায় তাকেই বলে শিষ্টাচার। মানবজীবনের অত্যাবশ্যক গুণাবলির অন্যতম হল এই সৌজন্য ও শিষ্টাচার। দেহের সৌন্দর্ৎ বৃদ্ধি পায় যেমন অলঙ্কারে, তেমনি আত্মার সৌন্দর্য বাড়ে শিষ্টাচারে। অলঙ্কার বাইরের সামগ্রী আর শিষ্টাচার অন্তরের। এবং সৌজন্যবোধ হলো তার মার্জিত প্রাত্যহিক জীবনচর্চা।
সৌজন্য ও শিষ্টাচারের বৈশিষ্ট্য :
১) জীবনবিকাশের ক্ষেত্রে শিষ্টাচার, ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধ অপরিহার্য। চলনে-বলনে, আচরণে, পোশাক-পরিচ্ছদে এবং ব্যক্তিত্ব, আভিজাত্য ও চারিত্রিক দীপ্তি প্রকাশেও এই গুণগুলো ক্রিয়াশীল থাকা জরুরি।
২) ঘরে বাইরে সর্বত্র শিষ্ট ও সৌজন্যমূলক আচরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে শিষ্টাচার হল একটি অপরিহার্য চারিত্রিক সম্পদ এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক ঐশ্বর্য।
৩) শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধ নিজের অসুবিধা সত্ত্বেয় পরের সুবিধা করে দিতে উৎসুক থাকে। শুধুমাত্র আত্মসুখ ও আত্মসমৃদ্ধি খোঁজে না।
৪) এই গুণের অধিকারী মানুষকে বলা হয় ভদ্রলোক।
৫) মানুষ আর পশুর মধ্যে পার্থক্য নিরূপন হয় এই গুণাবলীর নিরিখেই। দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, ‘দেহের সৌন্দর্যের চাইতে চিন্তার সৌন্দর্য অধিকতর মোহময় ও এর প্রভাব যাদুর মতো।’
শিষ্টাচারের প্রয়োজনীয়তা :
সমাজ জীবনের ভারসাম্য, শৃঙ্খলা, উন্নতি ও অগ্রসরতা অব্যাহত রাখতে পারস্পরিক শিষ্টাচার, ভদ্রতা, সৌজন্যতা ও অন্যান্য মানবিক মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। এককথায়, শিষ্টাচার হচ্ছে ভদ্র, মার্জিত ও রুচিসম্মত আচরণের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।
১) কথাবার্তায় ও আচার-আচরণে মার্জিত রুচি ও সুন্দর মনের পরিচয় দিতে,
২) পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে সর্বাত্মক সুন্দর করে তুলতে,
৩) জাতিতে জাতিতে বিরোধ, দ্বন্দ্ব থেকে পরিত্রান পেতে,
৪) সমাজে ও রাষ্ট্রে সুশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করতে,
৫) একে অপরের সুবিধা-অসুবিধা, মতামত ও অনুভূতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে চলতে,
৬) শোভন, সুন্দর ও প্রীতিময় আদব-কায়দার অনুশীলন করতে,
৭) ব্যাক্তি স্বাধীনতা বজায় রাখতে ও গনতান্ত্রিক পথ সুগম করে তুলতে,
৮) জাতিকে নতুন প্রাণ স্পন্দনে অনুপ্রাণিত করে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে,
৯) মানব জীবনের সার্বিক কল্যাণ করতে,
১০) একটি আদর্শ সমাজ গঠন করতে, প্রয়োজন সৌজন্য ও শিষ্টাচারের অনুশীলন।
শিষ্টাচার ও ভদ্রতার :
অনেকে শিষ্টাচার ও ভদ্রতার মধ্যে একটি সীমারেখা টেনে দেন। তাদের মতে শিষ্টাচার আন্তরিক গুণ, আর ভদ্রতা বাহ্যিক আচরণ মাত্র। ভদ্রতা অনেক সময়েই শুধু মৌখিক ও কৃত্রিম হয়ে থাকে; কিন্তু শিষ্টাচার মার্জিত রুচিসম্পন্ন হৃদয়ের নিজস্ব গুণ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ দু’টিকে পরস্পরের থেকে আলাদা করে যায় না। মৌখিকই হোক বা আন্তরিকই, অপরের প্রতি ভদ্র ব্যবহার করাই শিষ্টাচার। অধিকন্তু মৌখিকভাবে ভদ্র ব্যবহার করতে করতেই তা একদিন আন্তরিক গুণে পরিণত হতে পারে।মানুষের সদগুণাবলীর মধ্যে শিষ্টাচার যে অন্যতম প্রধান গুণ এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একারনেই নেপলিয়ন বলেছিলেন, ‘The greatest ornament of an illustrious life is modesty and humility’।
শিষ্টাচার ও সৌজন্য :
আক্ষরিকভাবে মার্জিত ও ভদ্র পরিশীলিত আচরণই শিষ্ঠাচার নামে পরিচিত। ব্যুৎপত্তিগত অর্থ থেকে সুজনের ভাবকে আমরা ‘সৌজন্য’ বলি। তাই তার যে ব্যবহারিক অর্থ আমাদের মধ্যে প্রচলিত তার সাথে শিষ্টাচারের বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। সুতরাং শিষ্টাচার ও সৌজন্যকে সমার্থক রূপেই সাধারণত গণ্য করা যায়।
শিষ্টাচার, ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক :
অপরের সুবিধা-অসুবিধা, মতামত ও অনুভূতির প্রতি সম্মান করে চলাই শিষ্টাচার ও সৌজন্যের লক্ষ্য। তা থেকে বুঝা যায় শিষ্টাচার ব্যক্তিগত গুণ হলেও সমাজের সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক। বস্তুত তা একটি স্বাভাবিক গুণ। এবং এই শিষ্টাচার ও সৌজন্য ব্যক্তি জীবনকে সফল ও জনপ্রিয় করে তোলে।
বিদ্যা, পাণ্ডিত্য ও শিষ্টাচারের সম্পর্ক
প্রসঙ্গত স্মরণীয়, বিদ্যা ও পাণ্ডিত্যের সাথে শিষ্টাচারের বিশেষ সম্পর্ক নেই। খ্যাতনামা পণ্ডিতও অশিষ্ট হতে পারেন। তবে একথা ঠিক যে, প্রকৃত বিদ্যা যেমন বিনয় দান করে, তেমনি তা মানুষকে শিষ্ট এবং সুজন হতে শিক্ষা দেয়।
শিষ্টাচারি হওয়ার উপায় :
শিষ্টাচার ও ভদ্রতা শিক্ষার বিষয়। কিন্তু উচ্চ শিক্ষিত হলেই যে এগুলো অর্জন করা যায় বিষয়টা এমন নয়। এর জন্য কোনো রকম অর্থ ব্যয় হয় না বটে; কিন্তু সাধনার প্রয়োজন। অন্যান্য গুণের মতো এ গুণটির শিক্ষাকালও শৈশব ও ছাত্রজীবন। ছাত্রজীবনে যে শিক্ষা দেওয়া হয় কর্মজীবনেও তা আমাদের প্রভাবিত করে। ছাত্রজীবনে শিষ্ট না হতে পারলে কর্মজীবনেও আমরা সফলতা লাভ করতে পারব না।
১) পরিবারের ভূমিকা :
শিষ্টাচারের বীজ মূলত বপিত হয় শিশুকালে। আর এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা প্রধান। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। পরিবারের বড়রা যে রকম ব্যবহার করে, শিশুরা তাই অনুকরণ করে। বাল্যকালে শিশুদের সংযম, বিনয় ও উন্নত রুচির চর্চা ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে শিষ্টাচার গড়ে তোলে।
২) শিক্ষা প্রতিষ্ঠাণের ভূমিকা :
একাডেমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা করে শিক্ষিত হওয়া যায়, মেধাবী হলে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে দেশের সীমানা পেরিয়ে ভিনদেশেও নাম কুড়ানো যায়; কিন্তু পরিবার থেকে সুশিক্ষা ও মূল্যবোধ না পেলে একসময় সব শিক্ষাই ম্লান হয়ে যায়। কারণ সভ্যতা, ভদ্রতা, নৈতিকতা, কৃতজ্ঞতা বোধ, অপরের প্রতি শ্রদ্ধা-স্নেহ, পরোপকার, উদার মানসিকতা- এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খুব বেশি অর্জন করা যায় না। এগুলোর ভিত্তি প্রোথিত হয় পারিবারিক মূল্যবোধ লালন-পালন ও সুশিক্ষার মাধ্যমে।
শিষ্টাচারের গুরুত্ব :
শিষ্টাচারহীন মানুষ কেবল আকৃতির দিক থেকেই মানুষ, তাদের মনুষ্যত্বের কোনো বিকাশ ঘটে না।
মানুষ আদিমকালে, মানুষ শিষ্টাচারের কোনো আবশ্যকতাই অনুভব করেনি। কিন্তু যখন মানুষ সমাজবদ্ধ হল, তখন থেকেই তাদের মধ্যে সামাজিক সম্পর্কের আবির্ভাব ঘটে। আর সেগুলোকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্যই প্রয়োজন হয় শিষ্টাচারের।
সমাজে বাস করতে হলে বিভিন্ন জনের সংস্পর্শে আসতেই হয় এবং তাদের সঙ্গে প্রীতি, সৌজন্যবোধ ও সখ্যতা বজায় রাখতে হয়। একমাত্র শিষ্টাচারের মাধ্যমেই তা সম্ভবপর।
সমাজের বসবাসকারী লোকের সঙ্গে কেউ যদি অশিষ্ট অভদ্র আচরণ করে, তবে সে স্বভাবতই তাদের বিরাগভাজন হয়ে পড়ে এবং ব্যক্তিগতভাবে আপনার জীবনের সাফল্যকে বিঘ্নিত করে।
শিষ্টাচার মানুষকে সংযমী ও বিনয়ী করে তোলে। শিষ্টাচারসম্পন্ন ব্যক্তি তার ভদ্র ও সংযত ব্যবহার দিয়ে যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে।
পৃথিবীতে যারা মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন, তারা শিষ্টাচার ও মার্জিত ব্যবহারের মাধ্যমেই মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। তবে এগুণ হঠাৎ করে কারো মধ্যে গড়ে ওঠে না। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ প্রস্তুতি, সাধনা ও শিক্ষা।
আপামর স্বার্থেও সামাজিক মানুষের পক্ষে শিষ্টাচার অপরিহার্য। মানুষের সুখ সমৃদ্ধি ও শান্তিকে তাই সহজলভ্য করে তুলতে পারে।
শিষ্টাচার ও সৌজন্য ব্যক্তি জীবনকে সফল ও জনপ্রিয় করে তোলে।
ছাত্রজীবন ও শিষ্টাচার
বিদ্যালয় শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক শিক্ষা অর্জনেরও আদর্শ সময় ছাত্রজীবন। কাজেই ছাত্রজীবন থেকেই আমাদের শিষ্টাচার এবং সৌজন্য শিক্ষায় প্রয়াসী হওয়া দরকার। শিষ্টাচার ও সৌজন্যের ছোঁয়াতেই একজন ছাত্র ভদ্র ও বিনয়ী হয়ে ওঠে। কাজেই ব্যক্তির সামাজিকীকরণ এবং সুখী-শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ জীবনের জন্যও ছাত্রজীবন থেকেই আমাদের সৌজন্য ও শিষ্টাচার শেখা একান্তভাবে জরুরি।
উপসংহার :
সমস্ত সদগুণাবলির মধ্যে সৌজন্য ও শিষ্টাচার যে অন্যতম প্রধান গুণ এ বিষয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। সন্দেহ নেই, এই দুইয়ে মিলেই ভবিষ্যৎ জীবনে চলার পথকে মসৃণ করে তোলে। এ কারণেই Oscar Wild তাঁর "The importance of Be ing Earnest-এ লিখেছেন, "Courtesy and Politeness are the basic principles which directs human life smoothly." সুতরাং ছাত্রজীবন থেকেই এ বিষয়ে যত্নবান হওয়া দরকার। স্কুল-কলেজে, অফিস-আদালতে, সভা-সমিতিতে বাসে ট্রেনে সমস্ত জায়গাতেই সৌজন্য ও শিষ্টাচারের চর্চা দরকার। শুধু সামাজিক নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনেও শিষ্টাচারের চর্চা আবশ্যক। কারণ, শিষ্টাচার একটি দেশ ও জাতির উন্নত মননের প্রতীক। তাই ছাত্রজীবনেই শপথ নিতে হবে শিষ্টাচার বিশিষ্ট জীবন ও সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে।
---------xx--------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন