বাংলার ঋতুরঙ্গ বা ঋতু বৈচিত্র্য
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।
— জীবনানন্দ দাস
ভূমিকা :
ঋতুবৈচিত্র্যের বর্ণিল উপস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রকৃতি পরিপূর্ণ। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা এই বাংলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর বৈচিত্র্যময় ঋতুরূপ। ভিন্ন ভিন্ন রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে পর্যায়ক্রমে ছয়টি ঋতু ঘুরে ফিরে আসে এই বাংলায়। প্রতিটি ঋতুই স্বতন্ত্র সৌন্দর্যে অপরূপা। বাংলা প্রকৃতির এই অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে জীবনানন্দ দাশ একে ‘রূপসী বাংলা’ বলে অভিহিত করেছেন।
ঋতু বৈচিত্রের কারণ :
বাংলাদেশ কর্কটক্রান্তি রেখার ওপর অবস্থিত। এখানকার আবহাওয়াতে তাই নিরক্ষীয় প্রভাব দেখা যায়। এখানেই রয়েছে বাংলার ঋতু বৈচিত্রের মূল চাবিকাঠি। নভেম্বর হতে মার্চ পর্যন্ত এখানে হালকা শীত অনুভূত হয়। মার্চ হতে জুন মাস পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল চলে। জুন হতে অক্টোবর পর্যন্ত চলে বর্ষা মৌসুম। এসময় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে হয় প্রচুর বৃষ্টিপাত।ছয় ঋতুর ‘রূপসী বাংলা’ :
বাংলার এই ছটি ঋতু যেন বিনি সুতোয় গাঁথা মালার মতো। এই মেলায় পর পর গাঁথা আছে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও ঋতুরাজ বসন্ত। প্রতি দুই মাস অন্তর ঋতু বদল হয়। এক ঋতু বিদায় নেয়, আসে অন্য ঋতু। নতুন ঋতুর ছোঁয়ায় প্রকৃতি সাজে নতুন রূপে। উপহার দেয় নতুন নতুন ফুল, ফল ও ফসল।
রুদ্র রূপে গ্রীষ্ম :
ঋতুচক্রের শুরুতেই ‘ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল’ নিয়ে আর্বিভূত হয় গ্রীষ্ম। প্রকৃতিতে সে আসে তার দূরন্ত ও রুদ্র রূপ নিয়ে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে খাল-বিল, নদী-নালা শুকিয়ে যায়। জলশূন্য মাটিতে ফাটল ধরে। গাছের পাতা রুক্ষ হয়ে যায়। অসহ্য গরমে একটু শীতল বাতাস ও ছায়ার জন্য মানুষসহ সমস্ত পশু-পাখি কাতর হয়ে পড়ে। গ্রীষ্ম শুধু জনজীবনে রুক্ষতাই ছড়ায় না- আম, কাঁঠালের ম ম গন্ধে ভরিয়ে দেয় ঘর-বাড়ি।
রুক্ষ বুকে সজল বর্ষা :
গ্রীষ্মের পরেই আসে বর্ষা। উত্তপ্ত প্রকৃতিকে স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে তুলতে যার জুড়ি মেলা ভার। এই সময় দূর আকাশে জমে ওঠা মেঘের স্তুপ বর্ষার আগমনী বার্তা নিয়ে ফিরে আসে। নদী-নালা কানায় কানায় ভরে যায়। অবিরাম বর্ষণে গ্রীষ্মের রুদ্র ও রুক্ষ প্রকৃতি সজীবতায় ভরে ওঠে। জনজীবনে ফিরে আসে প্রগাঢ় শান্তি। যেন প্রকৃতিতে কেউ ছড়িয়ে দেয় নিবিড় মায়ার কাজল কালো রঙ।
শুভ্রবেশে শরৎ রানি :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার ঋতুচক্রে শরতের অপরূপ রূপের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবেই —আজি ধানের ক্ষেত্রে রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরি খেলা
নীল -আকাশে কে ভাসালো সাদা মেঘের ভেলা।
নীল আকাশে তুলোর মতো ভেসে বেড়ায় শুভ্র মেঘ, আর নদীর দু’তীর উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সাদা কাশফুলের সমারোহে। শিউলি, কামিনী, জুঁই প্রভৃতি ফুলের সৌরভে মেতে ওঠে শরৎ প্রকৃতি। মৃদুমন্দ বাতাস ঢেউ খেলে যায় সবুজ মাঠে। শরৎ-এর ভোরে শিশিরের হালকা ছোঁয়া আর মিষ্টি রোদের সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে যায় বাংলার সমাজ। কবিগুরুর ভাষায়,
আজিকে তোমার মধুর মুরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে।
সোনায় মোড়া হেমন্ত :
শরতের রূপময়তার মুগ্ধতা কাটতে না কাটতেই বৈরাগ্যের বেশে আসে হেমন্ত। সর্ষে ফুলে ছেয়ে যায় মাঠের পর মাঠ। সোনালি রঙের পাকা ধানে ভরে যায় বাংলার দিগন্ত। কারণ, হেমন্ত মূলত ফসলের ঋতু। এ সময় মাঠে-ঘাটে থাকে শস্যের সমারোহ। নবান্নের উৎসবে মেতে ওঠে গ্রাম-বাংলার জনজীবন । হেমন্তের এই রূপেই মুগ্ধ হয়ে কবি গুরু গেয়ে ওঠেন,ওমা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে
কী দেখেছি মধুর হাসি।
শীতে মোড়া পুলি পিঠা :
হেমন্ত বিদায় নিতে না নিতেই আসে শীত। ঘন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে উত্তুরের হাওয়ায় ভেসে সে যেন আসে চুপি চুপি। নানা রকম শাক-সবজি, ফল ও ফুলের ডালি সাজিয়ে ধরে মহাসমারোহে। আর আমরা তাকে বরণ করি। এই সময় একদিকে যেমন শীতের কষ্ট আমাদের কাবু করে, অন্যদিকে তেমনি ফুল-ফল-ফসল ও পিঠা-পুলির সমারোহ এই কষ্টের ওপর আনন্দের প্রলেপ ফেলে মধুময় করে দেয়। কবি গুরু তাই লিখেন —শীতের হাওয়া লাগল আজি
আমলকির ঐ ডালে ডালে।
ঋতুর রাজা বসন্ত :
সবশেষে, রাজার বেশে হাজির হয় ঋতুরাজ বসন্ত। এই সময় শীতের শুষ্ক ও রিক্ত অবস্থাকে মুছে ফেলে প্রকৃতি ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। দক্ষিণা মৃদু বাতাসে প্রকৃতির মনে যেন দোলা লাগে। কোকিলের কুহুতানে জেগে ওঠে বাংলার আকাশ বাতাস। শিমুল,পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, অর্জুন প্রভৃতি রঙ-বেরঙের ফুলে সেজে ওঠে প্রকৃতি, বসন্তের পরশে । আমের মুকুলের মৃদু সৌরভে ম ম করে ওঠে বাতাস। কবি ভাবেন -
ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে।
বাঙালি জীবনে ষড়ঋতুর প্রভাবঃ
বাংলার এই ঋতুবৈচিত্র্য কেবল প্রকৃতির বুকে নয়, সমান তালে প্রভাব ফেলে মানব মনে এবং তার জীবনযাপনেও। ঋতুর প্রভাব বাঙালির সংস্কৃতি, কাব্য-সাহিত্য ও সংগীতে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। ঋতুভেদে গ্রাম বাংলার জীবনে উদযাপিত হয় নানারকম পূজা-পার্বণ, মেলা ও উৎসব। অর্থাৎ ষড়ঋতুর পালাবদলের সাথে এ দেশের জনজীবন গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। কবির রূপকল্পে তা যেন,
ছয় সেবাদাসী
ছয় ঋতু ফিরে ফিরে নৃত্য করে আসি।
উপসংহারঃ
সত্যিই অনবদ্য সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলার এই ঋতুবৈচিত্র্য। ষড়ঋতুর স্বতন্ত্র এই সৌন্দর্যের কোনো তুলনা হয় না। কিন্তু আশঙ্কার কথা হল, ধীরে ধীরে শহরজীবন ঋতুবেচিত্র্যের এই প্রভাব থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। যান্ত্রিক সভ্যতার আগ্রাসন ও তারই সুত্রে বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়নের দপটে তার এখন নাভিশ্বাস প্রায় দশা। প্রতিটি ঋতু তাই এখন বিপন্ন। সতর্ক না হলে, এই বিপন্নতা অচিরেই গ্রাস করবে বাংলা তথা বাঙালিকে - একথা হলপ করে বলা যায়।
---------------xx--------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন