“আমার ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়া-ফুল, / নামুক মহুয়ার গন্ধ।”
ক) ‘আমার’ বলতে কার কথা বলা হয়েছে? - ২০১৭
খ) এমন কামনার কারণ কী? - ২০১৭
গ) কবির ক্লান্তির স্বরূপ ব্যাখ্যা করো।
ঘ) বক্তা কোথায় ‘মহুয়ার গন্ধ’ নামতে বলেছেন?
ঙ) কবিতায় কবির কোন সত্য উপলব্ধি হয়েছে?
ক) ‘আমার’ পরিচয়:
নাগরিক কবি সমর সেনের লেখা ‘কয়েকটি কবিতা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘মহুয়ার দেশ’ নামক কবিতা থেকে উদ্ধৃত অংশটি গৃহীত হয়েছে। এই কবিতায় ‘আমার’ বলতে কবি নিজের কথা বুঝিয়েছেন।
খ) এমন কামনার কারণ :
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে বিশ্বব্যাপী দুর্বার গতিতে বেড়ে ওঠে নগরায়ন। ব্রিটিশ শাসনের সূত্রে কলকাতায়ও তার প্রভাব পড়ে। গড়ে ওঠে শিল্প কারখানা। ফলে শিল্প কারখানার ধুলো ও ধোঁয়ায় নগরের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে ওঠে। এই বিষাক্ত ধুলো ও ধোঁয়া শীতের শিশিরকে আশ্রয় করে ধোঁয়াশায় রূপ নেয় এবং তাতেই ভরে যায় চতুর্দিক। কবির কথায়,
ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস ঘুরে ফিরে ঘরে আসে
শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়া সেই ‘ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাসে’ কবির যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। শহর জীবনকে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। নাগরিক কবি সমর সেন এই পরিবেশকেই ‘শীতের দুঃস্বপ্নের মতো’ বলে অভিহিত করেছেন।
নগর জীবনের এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেতে কবি চলে যেতে চেয়েছেন মেঘ-মদির মহুয়ার দেশে। কারণ, কবির বিশ্বাস, সেখানে পথের দু’ধারে সারাক্ষণ সার দিয়ে দাড়িয়ে থাকা দেবদারুর রহস্যময় দীর্ঘ ছায়া খেলা করে। দূর থেকে ভেসে আসে সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাসরূপী গর্জন, যা তাকে সুমধুর গানের মত আকৃষ্ট করে। প্রকৃতির এই নির্মলতাকে আশ্রয় করেই কবি নাগরিক জীবনের একঘেয়েমি ও ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন। তাই তিনি এই কামনা করেছেন :
আমার ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়া-ফুল
নামুক মহুয়ার গন্ধ।
গ) কবির ক্লান্তির স্বরূপ :
কবির এই ক্লান্তির স্বরূপ জানতে হলে আমাদের পাড়ি দিতে হবে অষ্টাদশ শতাব্দীর সুদূর ইউরোপে। এই সময় সেখানে ঘটে ‘শিল্প বিপ্লব’। শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়ায় বিশ্বজুড়ে গড়ে ওঠে আধুনিক নগর সভ্যতা। এই সভ্যতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এমন সব কলকারখানায় নগর ভরে যাওয়া, যা ভয়ানক নগর দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কবি লক্ষ্য করেন, ‘অগণন ধোঁয়ার ফনা, চিমনিতে ছিড়েছে আকাশ’। উপলব্ধি করেন, ‘দিকে দিকে আজ হানা দেয় বর্বর নগর’।
এই কবিতায়ও কবি তুলে ধরেছেন কলকারখানার ধোঁয়ায় দূষণের ভয়ানক চিত্রকল্প। লিখেছেন,
ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস ঘুরে ফিরে ঘরে আসে
শীতের দুঃস্বপ্নের মতো।
সুতরাং ইউরোপীয় শিল্প বিপ্লবের ফলে উদ্ভূত শিল্প দানবের ছোঁয়ায় নগর জীবনের শ্বাস-বন্ধ হয়ে যাওয়া পরিবেশই নাগরিক কবির ক্লান্তির অন্যতম প্রধান কারণ।
ঘ) মহুয়ার গন্ধ কোথায় নামবে :
যন্ত্র সভ্যতার ভয়ানক দূষণ নাগরিক কবি সমর সেনের জীবনকে একাকীত্ব, একঘেয়েমি ও ক্লান্তিতে ভরিয়ে দেয়। জীবন হয়ে ওঠে দুঃসহ। তাই নগর জীবনের সাময়িক মুগ্ধতা ছেড়ে তিনি চলে যেতে চেয়েছেন মেঘ-মদির মহুয়ার দেশে, যেখানে আছে মহুয়া ফুল আর তার গন্ধ। কবির বিশ্বাস এই মহুয়া-ফুল ও তার গন্ধ নগর জীবনের ক্লান্তি থেকে তাকে মুক্তি দেবে। তাই কবি চেয়েছেন তার নিঃসঙ্গ জীবনের সমস্ত ক্লান্তির উপর নেমে আসুক মহুয়ার গন্ধ। কবির কথায় :
আমার ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়া-ফুল
নামুক মহুয়ার গন্ধ।
ঙ) কবির কোন সত্য উপলব্ধি হয়েছে :
নাগরিক কবি সমর সেন মহুয়ার দেশ কবিতায় প্রকৃতির সান্ধ্যকালীন সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছেন নিপুণভাবে। জানিয়েছেন তাঁর মুগ্ধতার কথা। সঙ্গে এও জানিয়েছেন, এই মুগ্ধতা বড়ই ক্ষণস্থায়ী। কারণ, অচিরেই যন্ত্র সভ্যতার বিষ বাষ্প ‘শীতের দুঃস্বপ্নের মতো’ তার ঘরকেও ঢেকে ফেলছে প্রতিদিন। তিনি উপলব্ধি করেন, শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়ায় এবং শিল্প পুঁজির আগ্রাসনে নগর জীবনে উঠছে নাভিশ্বাস। এই সূত্রেই কবি ক্লান্ত ও অবসন্ন।
শেষমেষ এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেতে তিনি ছুটে যান শহর থেকে দূরে, মেঘ-মদির মহুয়ার দেশে। তার বিশ্বাস ছিল, এই অরণ্যভূমি এখনও পুঁজির আগ্রাসনে কলুষিত হয়নি। কিন্তু সেখানে গিয়ে তার স্বপ্নভঙ্গ ঘটে। তিনি দেখেন, শিল্প পুঁজির করাল থাবা অরণ্য ভূমির নির্জনতাকেও নির্মমভাবে ভেঙে ফেলছে। তাই রাতের নিবিড় অন্ধকারেও ভেসে আসছে ‘কয়লা খনির গভীর ও বিশাল শব্দ’ যা কবির কাছে অসহ্য লাগে। এভাবে ঘুমহীন মানুষের অবসন্ন, ক্লান্ত ও মলিন মুখ অরণ্য ভূমির বাতাসকে ভারী করে তোলে। কবি মুখোমখি হন এক অমোঘ সত্যের। উপলব্ধি করেন, যন্ত্র সভ্যতার করাল ছায়া থেকে শুধু শহর বা নগর নয়, অরণ্য ভূমিরও বোধ হয় মুক্তি নেই।
-----------xx----------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন