‘মহুয়ার দেশ’ কবিতার মূল বক্তব্য
The essence of the poem 'Mahuar Desh'
‘মহুয়ার দেশ’ কবিতার দুটি পর্বে কবির যে আলাদা আলাদা বক্তব্য ফুটে উঠেছে তা নিজের ভাষায় লেখো।
অথবা,
‘মহুয়ার দেশ’ কবিতায় কবি মহুয়ার দেশের যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তার পরিচয় দাও।
🔘 ভূমিকা :
নাগরিক কবি সমর সেন রচিত ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতাটি নাগরিক জীবনের যান্ত্রিকতায় ও একঘেয়েমিতে ক্লান্ত, একজন প্রকৃতি প্রেমিক মানুষের জীবন যন্ত্রণার অনবদ্য প্রতিচ্ছবি।
🔘 নাগরিক কবির স্বপ্ন :
দুই পর্বে ভাগ করা এই কবিতার প্রথম পর্বে কবি নাগরিক জীবনের যান্ত্রিকতা ও একঘেয়েমি থেকে মুক্তির জন্য প্রকৃতির মাঝে আশ্রয় নিতে চেয়েছেন। কোলাহল মুখর শহরের পড়ন্ত বিকেলে ‘অলস সূর্য’ বিদায় নেয়ার সময় ‘গলিত সোনার মত’ যে ‘উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ’ এঁকে দেয় ‘সন্ধ্যার জলস্রোতে’, তা কবিকে মুগ্ধ করে। কবির উপমায় তা এভাবে ফুটে ওঠে :অলস সূর্য দেয় এঁকে
গলিত সোনার মতো উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ,
আর আগুন লাগে জলের অন্ধকারে ধূসর ফেনায়।
কিন্তু ক্ষণিকের এই মুগ্ধতা কবি চিত্রকে আলোড়িত করলেও অচিরেই তার মোহভঙ্গ ঘটে। কারণ, কবির কথায়,
ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস ঘুরে ফিরে ঘরে আসে
শীতের দুঃস্বপ্নের মত।
🔘 কবির রোমান্টিক চেতনার প্রকাশ :
ব্যথিত কবি তাই শহর জীবন ছেড়ে চলে যেতে চান আদিম অরণ্যের বুকে, যেখানে আছে ‘মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ’। কারণ, কবির রোমান্টিক ভাবনায় ধরা পড়ে, এই মহুয়ার দেশে রয়েছে দীর্ঘ দেবদারু গাছের সুদীর্ঘ রহস্যময় প্রগাঢ় ছায়া। রয়েছে ‘দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস’, যা রাত্রের নির্জন নিঃসঙ্গতাকে আলোড়িত করে। এ যেন, মৃদঙ্গ-করতালের বলবান শব্দের ঘটার মধ্যে বেহালার একটি তারের একটানা তান যেমন সকলকে ছাপিয়ে বুকের ভেতরে বাজতে থাকে, তেমনি করে সেই ‘দূর সমুদ্রের’ ধীর গম্ভীর দীর্ঘশ্বাস, সুরের অবিরাম ধারার মত সমস্ত আকাশের মর্মস্থলকে পূর্ণ করে উচ্ছলিত করে তোলে কবির হৃদয়কে (‘অন্তর-বাহির’ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। তারপর নগর জীবনের সারাদিনের ক্লান্তির ওপর মহুয়া-ফুল ও তার গন্ধ মিলে কবিকে এনে দেবে ক্লান্তিহীন এক অনাবিল মুক্তির স্বাদ।
🔘 কবির স্বপ্ন ভঙ্গ :
দ্বিতীয় পর্বে কবি এঁকেছেন তাঁর স্বপ্নভঙ্গের করুণ চিত্র। মহুয়ার দেশে পৌঁছে কবি উপলব্ধি করেছেন এখানকার অরণ্য-জীবনেও লেগেছে বিপর্যয়ের ঢেউ। ধনতান্ত্রিক অর্থ-ব্যবস্থার আগ্রাসনে সেখানকার আদিম সমাজব্যবস্থা আজ প্রায় ধ্বংস হতে বসেছে। অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক শোভার বক্ষ চিরে তাই মাঝে মাঝে ভেসে আসছে কয়লা খনির ‘গভীর’ ও ‘বিশাল’ শব্দ যা কবির কাছে অসহ্য লাগছে।
আবার শিশির ভেজা সবুজ সকালে উঠে তিনি বিস্মিত নয়নে দেখছেন, ধুলোর কলঙ্ক মাখা রাতজাগা শ্রমিকের দুঃস্বপ্ন পীড়িত, ক্লান্ত ও অবসন্ন মুখ নিয়ে মহুয়ার দেশ আজ ভারাক্রান্ত। কবির কথায়,
অবসন্ন মানুষের শরীরে দেখি ধুলোর কলঙ্ক,
ঘুমহীন তাদের চোখে হানা দেয়
কীসের ক্লান্ত দুঃস্বপ্ন।
এভাবে কবিতার প্রথম স্তবকে কবির রোমান্টিক ভাবনায় ভেসে ওঠা ‘মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ’, দ্বিতীয় স্তবকে এসে রোমান্টিকতার আড়ালে থাকা ‘অসহ্য নিবিড় অন্ধকারে’ ভরা এক দুঃস্বপ্নের দেশ হয়ে ধরা দেয়।
--------xx-------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন