সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ছোটগল্প : ভাত — মহাশ্বেতা দেবী

 দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা ছোটগল্প : ভাত — গল্পকার মহাশ্বেতা দেবী

মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্প — ভাত
ছোটগল্প : ভাত — মহাশ্বেতা দেবী 

লোকটার চাহনি বড় বাড়ির বড় বউয়ের প্রথম থেকেই ভালো লাগেনি। কিরকম যেন উগ্র চাহনি। আর কোমর পর্যন্ত ময়লা লুঙ্গিটা অত্যন্তই ছোট। চেহারাটা বুনুবুণু। কিন্তু বামুন ঠাকুর বলল, ভাত খাবে কাজ করবে।

কোথা থেকে আনলে?

এ সংসারে সবকিছুই চলে বড় পিসিমার নিয়মে। বড় পিসিমা বড় বউয়ের পিসি শাশুড়ি হন। খুবই অদ্ভুত কথা। তার বিয়ে হয়নি।

সবাই বলে, সংসার খেলবার কারণে অমন বড়লোক হয়েও ওরা মেয়ের দিয়ে দেয়নি। তখন বউ মরে গেলে বুড়ো কর্তা সংসার নিয়ে নাটা-ঝামটা হচ্ছিল।

বড় বাড়ির লোকেরা বলে, ওর বিয়ে ঠাকুরের সঙ্গে। উনি হলেন দেবতার সেবিকা।

বড় বাড়িতে শিবমন্দিরও আছে একটা। বুড়ো কর্তা এ রাস্তার সবগুলো বাড়িই শিব-মহেশ্বর-ত্রিলোচন-উমাপতি, এমন বহু নামে শিবকে দিয়ে রেখেছিলেন। দূরদর্শী লোক ছিলেন। তার জন্যই এরা করে খাচ্ছে। বড় পিসিমা নাকি বলেছিলেন, উনি আমার পতিদেবতা। মানুষের সঙ্গে বিয়ে দিও না।

এসব কথা সত্যি না মিথ্যে কে আনে। বড়ো পিসিমা চিরকাল এ সংসারে হেঁশেল দেখেছেন, ভাড়াটে বাড়িতে মিস্তিরি লাগিয়েছেন এবং তাঁর বাবার সেবা করেছেন।

বড়ো বউয়ের কথা শুনে বড়ো পিসিমা বলেন, কোথা থেকে আনলে মানে? ঝড়জলে দেশ ভেসে গেছে। আমাদের বাসিনীর কে হয়। সেই ডেকে আনলে।

বড়ো বউ বলে, কী রকম দেখতে!

ময়ূরছাড়া কার্তিক আসবে নাকি? তোমরা তো দশটা পয়সা দিতে পারবে না প্রাণে ধরে। এই চোদ্দো দফায় কাজ করবে, পেটে দুটো খাবে বইতো নয়। কেনা চাল নয়, বাদা থেকে চাল আসছে। তা দিতেও আঙুল বেঁকে যাচ্ছে?

বড়ো বউ চুপ করে যায়। বড়ো পিসির কথায় আজকাল কেমন যেন একটা ঠেস থাকে। 'তোমাদের' মানে কী? বড়ো পিসিমা কি অন্য বাড়ির লোক নাকি?

বড়ো পিসিমা শেষ খোঁচাটা মারেন। তোমার শ্বশুরই মরতে বসেছে বাছা। সে জন্যেই হোম-যদি হচ্ছে। তার জন্য একটা লোক খা…..

বড়ো বউ কোনো কথা বলে না। সব কথাই সত্যি। তার শশুরই মরতে বসেছেন। বিরাশি বছরটা অনেক বয়েস। কিন্তু শ্বশুর বেশ টনকো ছিলেন। তবে ক্যানসার বলে কথা। ক্যানসার যে লিভারে হয় তাই বড়ো বউ জানতো না। বড়ো বউ প্রায় দৌড়ে চলে যায়।

আজ অনেক কাজ। মেজ বউ উনোন পাড়ে বসেছে। শাশুড়ির মাছ খাওয়া বুঝি ঘুচে যায়। তাই কয়েকদিন ধরে বড়ো ইলিশ, পাকা পোনার পেটি, চিতলের কোল, ডিমপোরা ট্যারো, বড়ো ভেটকি মাছের যজ্ঞি লেগেছে। রেঁধে-বেড়ে শাশুড়িকে খাওয়ানো তার কাজ।

শ্বশুরের ঘরে নার্স। বাড়া বউ এখন গেল সে ঘরে। সে একটু বসলে পরে নার্স এসে চা খেয়ে যাবে। সেজ ছেলে বিলেতে। তার আসার কথা ওঠে না। ছোটো মেজ ও বড়ো ঘুমোচ্ছে। এ বাড়ির ছেলেরা বেলা এগারোটার আগে ঘুম থেকে ওঠে না। সেই জন্যেই তাদের চাকরি করা হয়ে ওঠেনি। আঠারোখানা দেবত্র বাড়ি আর বাদা অঞ্চলে অসাগর জমি থাকলে কাজ বা করে কে?

শ্বশুরের ঘরে বসে বড়ো বউ ভাবতে চেষ্টা করে শ্বশুর নেই, সে অবস্থাটা কেমন হবে। ক্যানসার, লিভারে ক্যানসার, তা আগে বোঝা যায়নি। বোঝা গেল যখন, তখন আর কিছু করবার নেই। বড়ো বউ ভাবতে চেষ্টা করে, তখনও চাঁদ সূর্য উঠবে কি না। শ্বশুর তার কাছে ঠাকুরদেবতা সমান।

তাঁর জন্য দই পেতে ইসবগুল দিয়ে শরবত করে দিতে হতো, শত ঠাকুর আসুক, তিনি খেতে আসার পাঁচ মিনিট আগে বড়ো বউকে করতে হতো রুটি-লুচি। তাঁর বিছানা পাততে হতো, পা টিপতে হতো। কত কাজ করতে হত সারা জীবন ধরে। এখন সে সব কি আর করতে হবে না, কে জানে।

ডাক্তাররা বলে দিয়েছে বলেই তো আজ এই যজ্ঞি-হোম হচ্ছে। ছোটো বউয়ের বাবা এক তান্ত্রিক এনেছেন। বেল, ক্যাওড়া, অশ্বত্থ, বট, তেঁতুল গাছের কাঠ এসেছে আধ মন করে। সেগুলো সব এক মাপে কাটতে হবে। কালো বেড়ালের লোম আনতে গেছে ভজন চাকর। শ্মশান থেকে বালি, এমন কত যে ফরমাশ ।

তা ওই লোকটাকে ধরে আনা কাঠ কাটার জন্যে। ও নাকি ক'দিন খায়নি। বাসিনী এনেছে। বাদায় থাকে, অথচ ভাতের আহিনকে এতখানি। এ আবার কী কথা? বাদার চালের অভাব নাকি? দেখো না একতলায় গিয়ে। ডলে ডলে কত রকম চাল থরে থরে সাজানো আছে।

নার্স এসে বসে। বড়ো বউ নেমে যায়। আজ খাওয়া-দাওয়া ঝপ করে সারতে হবে তান্ত্রিক হোমে বসবার আগে। হোম করে তান্ত্রিক শ্বশুরের প্রাণটুকু ধরে রাখবেন। তান্ত্রিক নীচের হল ঘরে বসে আছেন।

বড়ো পিসিমা বলেন, নামতে পারলে বাছা? চালগুলো তো বের করে দেবে?
    - এই যে নিই।

ঝিঙেশাল চালের ভাত নিরামিষ ডাল তরকারির সঙ্গো। রামশাল চালের ভাত মাছের সঙ্গে। বড়োবাবু কনকপানি চাল ছাড়া খান না, মেজো আর ছোটোর জন্য বারোমাস পদ্মজালি চাল রান্না হয়। বামুন চাকর ঝি-দের জন্য মোচা সাপ্‌টা চাল। বাদার লোকটি কাঠ কাটতে কাটতে চোখ তুলে দেখে। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে। তার।
    - হ্যাঁ। বাসিনী, এত নানানিধি চাল?
    -বাবুরা খায়।
    - এই পাঁচ ভাগে ভাত হয়।
    - হবে নে? বাদায় এদের এত জমি। চাল এনে পাহাড় করেছে। বড়ো পিসিমা বেচেও দিচ্ছে নুক্কে নুক্কে। আমিই বেচতেছি সে চাল।
    - বাদায় এদের চাল হয়! তা দে দেখি বাসিনী। এক মুক্তি চাইল দে। গালে দে জল যাই। বড্ড ঝ্যামন আঁচড় কাটতিছে পেটের মধ্যিখানে। সেই ক'দ্দিন ঘরে আদা ভাত খাই না। সে বাসিনী ব্যাগাতা করি তোর।
    - আরে আরে! কর কি উচ্ছব দাদা। গাঁ সম্পর্কে দাদা তো হও। কেন বা এমন করতেছ। পিসিমা দেকতে পেলে সব্বনাশ হবে। আমি ঠিক তাগেবাগে দে ঝাব। তুমি হাত চালিয়ে নাও দেকি বাবা। এদেরকে বলিহারি ঝাই। এটা লোক কদিন খায়নি শুনচ। আগে চাট্টি খেতে দে।

বাসিনী চালগুলি নিয়ে চলে যাবার সময়ে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে যায়। লোকটির নাম উৎসব। চিরকালই যে উচ্ছব নাইয়া নামে পরিচিত। গত কয়েকদিন সে সত্যিই খায়নি। কপালটা মন্দ তার। বড়োই মন্দ যত দিন রান্না খিচুড়ি দেয়া হচ্ছিল ততদিন সে খেতে পারেনি। অ চুন্নুনীর মা। চুন্নুনীরে! তোমরা রা কাড় না ক্যান- কোতা অইলে গো!

বস্তুত এ সব বলে সে যখন খুঁজছিল বউ ছেলে মেয়েকে তখন তার বুদ্ধি হরে গিয়েছিল। একদিন তুমুল ঝড়বৃষ্টি। ছেলে-মেয়েকে জাপটে সাপটে ধরে বউ কাঁপছিল শীতে আর ভয়ে। সে ঘরের মাঝ খুঁটি ধরে মাটির দিকে দাবাচ্ছিল। মাঝ-খুঁটিটি মাতাল আনন্দে টলছিল, ধনুষ্টঙ্কার রোগীর মতো কেঁপেঝোঁকে উঠছিল। উচ্ছব বলে চলছিল ভগমান! ভগমান! ভগমান! কিন্তু এমন দুর্যোগে ভগবান ও কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমোন বোধ করি। ভগমান! ভগমান! উচ্ছব বলছিল। এমন সময়ে মাতলার জল বাতাসের চাবুকে ছটফটিয়ে উঠে এসেছিল। জল উঠল। জল নামল! উচ্ছবদের সংসার মাটিতে লুটোপুটি গেল।

সকাল হতেই বোঝা গিয়েছিল সর্বনাশের বহরখানা। তারপর কয়েকদিন ধরে ঘরের চালের নীচ থেকে কোনো সাড়া পাবার আশায় উচ্ছব পাগল হয়ে থাকে। কে, কোথায়, পাগল নাকি উচ্ছব? সাধন দাশের কথা উচ্ছব নেয় না। সাধন বলে, তোরেও তো টেনে নেচ্ছেল। গাছে বেধে রয়ে গেলি। উচ্ছব বলে রা কাড় অ চুন্নুনীর মা! ঘরের পাশ ছেড়ে সে নড়তে চায় না। তা ছাড়া টিনের বেশ একটা মুখবন্ধ কৌটো ছিল ঘরে। তার মধ্যে ছিল নিভুই উচ্ছবের জমি-চেয়ে দরখাস্তের নকল। উচ্ছব নহিয়া। পিং হরিচরণ নাইয়া। সে কৌটোটা বা কোথায়।

যা আর নেই, যা ঝড়-জল-মাতলার গর্ভে গেছে তাই খুঁজে খুঁজে উচ্ছব পাগল হয়েছিল। তাই রান্না খিচুড়ি তার খাওয়া হয়নি। তারপর যখন তার সম্বিত ফিরল, তখন আর খিচুড়ি নেই। ড্রাইডোল। চালগুলি সে চিবিয়ে জল খেয়েছিল। এভাবে কিছুদিন যায়। তারপর গ্রামের লোকজন বলে, মরেচে যারা তাদের ছরাদ্দ কত্তে হয়। একাজ করার জন্যে তারা মহানাম শতপথিকে খবর দেয়। কিন্তু মহানাম এখন আর দুটো গ্রামে অনুরূপ শ্রাদ্ধশান্তি সেরে তবে এখানে আসবে। গ্রামবাসী অন্যেরা মাছ-গুগলি-কাঁকড়া যা পাচ্ছে ধরতে লেগেছে। উচ্ছবকে সাধন বলে, তুমি একা কলকেতা যাব বলে নেচেই বা উটলে কেন? সরকার ঘর করে খরচা দেবে শুনছ না?

উচ্ছব হঠাৎ খুব বুদ্ধিমান সাজতে চায় ও বলে, সে এট্টা কতা বটে।

ঝড় জলে কার কী হলো, মা-ভাই-বোন আছে না গেছে দেখতে বাসিনী আসতে পারেনি। তার বোন আর ভাজ কলকাতা যাচ্ছিল। ওরা কিছুকাল ঠিকে কাজ করবে। উচ্ছব আগেও গিয়েছিল একবার। বাসিনী যেখানে কাজ করে সে ঘর বাড়ি দেখেছিল বাইরে থেকে। বার-বাড়িতে ঠাকুর দালান আছে, মন্দিরের মাথায় পেতলের ত্রিশূলটা দেখেছিল। বাসিনীর মনিব বাড়িতে হেলা ঢেলা ভাত, এ গল্প গ্রামে সবাই শুনেছে। উচ্ছবের হঠাৎ মনে হয় কলকাতা গিয়ে খেয়ে মেখে আসি। কেন মনে হয়েছিল তা সে বলতে পারে না। উপোসে, এক রাতে বউ ছেলে মেয়ে ঘরদোর হারিয়ে সে যেন কেমন হয়ে যাচ্ছিল। মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করে, কোনো কথা গুছিয়ে ভাবতে পারে না। খুব ভাবে সে, না না। এইবার গুচিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কী যে হলো তা একনো দিশে হাচ্ছে না তেমন। ভাবতে গেলেই তার প্রথমে মনে হয় ধানে গোছ আসার আগেই ধান গাছ থেকে সবুজ রং চলে যেতে থাকে। কার্তিক মাসেই ধান খড় হয়ে গেল। তা দেখে উচ্ছব মাথায় হাত দিয়েছিল। সতীশ মিস্তিরির হরকুল, পাটনাই, মোটা তিন ধানে মড়ক। উচ্ছব তো সতীশের কাজ করেই ক'মাস বেঁচে থাকে। অ উচ্ছব, মনিবের ধান যায় তো তুই কাদিস কেন? কাঁদব না, সাধনবাবু, কাঁদব না? লক্ষ্মী না আসতে সেধে ভাসান যাচ্ছে তা কাঁদব না এতটুকু? আমরা খাব কী?

তা গুছিয়ে চিন্তা করতে বসলে আগে মনে হয় ধানক্ষেতে আগুন লাগার কথা। তারপরই মনে পড়ে যে রাতে ঝড় হয়। সেই সন্ধেয় অনেকদিন বাদে সে পেট ভরে খেয়েছিল। এই এত হিংচে সেদ্দ আর এত গুগলি সেদ্দ নুন আর লঙ্কা পোড়া দিয়ে। দিনটা এমন ছিল যে সেদিন গ্রামের সকল উচ্ছবরা ভরা পেট খেয়েছিল। খেতে খেতে চরুনীর মা বলেছিল— দেবতার গতিক ভালো নয়কো। লৌকো নে কারা বেইরেচে বুজি বা বোট মারা পরে, এ কথাটাও বেশ মনে পড়ে। তারপরেই মনে পড়ে মাঝ-খুঁটিটা সে মাটির দিকে ঠেলে ধরে আছে। মা বসুমতী ঝেমন সে খুঁটি রাখতে চায়নে, উগরে ফেলে দেবে। ভগমান! ভগমান! ভগমান! তারপর বিদ্যুচ্চমকে ক্ষণিক আলোয় দেখা মাতলার সফেন জল ছুটে আসছে। ব্যাস, সব খোলামেলা, একাকার তারপর থেকে। কী হল। কোথায় গেল সব, তুমি কোথায়, আমি কোথায়। উচ্ছব নাইয়া। পিং হরিচরণ নাইয়া। কাগজসহ কৌটোটি কোথায়। বড়ো সুন্দর কৌটোখানি গো! চুন্নুনীদের যদি রেখে যেত ভগবান, তাহলে উচ্চবের বুকে শত হাতির বল থাকত আজ। তাহলে সে কৌটো নিয়ে সবাই ভিক্ষয় বেরত। সতীশবাবুর নাতি ফুট খায়। উজ্জ্বল কৌটোটো চেয়ে এনেছিল। অমন কৌটো থাকলে দরকারে একমুঠো ফুটিয়ে নেয়া যায়। চমৎকার কৌটো।

    - কী হলো, হাত চালাও বাছা। এদিকে শূষচে কত্তা, হোম হবে, তা কাটগুনো দাঁড়িয়ে দেখছ? বড়ো পিসিনা খনখনিয়ে ওঠে।
    - বড়ো খিদে নেগেছে মা গো!
    - এই শোন কতা! ভাত নামলেও খাওয়া নেই একন। তান্ত্রিকের নতুন বিধেন হল, সর্বস্ব রেঁধে রাখো, হোম হলে যেও। তুমি হাত চালাও।

উচ্ছব আবার কাঠ কাটতে থাকে। প্রত্যেকটি কাঠ দেড় হাত লম্বা হবে। ধারালো কাটারিটি সে তোলে এ নামায়। ফুটন্ত ভাতের গন্ধ তাকে বড়ো উতলা করে। এদিক ওদিক চেয়ে বাসিনী ঝুড়ি বোঝাই শাক নিয়ে উঠোনে ধুতে আসে। ঝপ করে একটা ঠোঙা তার হাতে নিয়ে বলে, ছাতু খেয়ে জল খেয়ে এসো রাস্তার কল হতে। দেরি কোরো না মোটে। এ পিশাচের বাড়ি কেমন তা ঝাননি দাদা। গরিবের গতর এরা শস্তা দেকে।
    - কে মরতেচে হ্যাঁ বাসিনী?
    - তেকেলে বুড়ো। বাড়ির কত্ত। মরবেনে? ওই ঝে হোমের জোগান দিচ্ছে, ওই মুটকি শুনার খাস ঝি! কত্ত মোলে পরে ওকে সাত নাতি না মেরেচি তো আমি বাসিনী নই। তেকেলে বুড়ো মরছে তার ঝন্যি হোম।

ছাতু ক'টি নিয়ে উচ্ছব বেরিয়ে যায়। বাপ রে! এত তরকারি, এত ডাল এত মাছ এ একটা যজ্ঞি বটে। সব নাকি বাদার দৌলতে। সে কোন বাদা। উচ্ছবের বাদায় শুধু গুগলি-গেড়ি কচুশাক সুশনো শাক। উচ্ছব ছাতার একটু খায়, মিষ্টির দোকানে ভাঁড় চেয়ে নিয়ে জল যায়। ছাতু নাকি পেটে পড়লে ফুলে ফেঁপে ওঠে। তাই হোক। পেটের গভর ভরুক। কিন্তু সাগরে শিশির পড়ে। উচ্ছব টের পায় না কিছু। সে আবার ফিরে আসে।
    - কোথা গেছলে?
    - এট্টু বাইরে গেলাম মা!
কাঠ কাটলে হোম, হোম হলে ভাত, উচ্ছব তাড়াতাড়ি হাত চালায়। মেজ বউ চেঁচিয়ে বলে, খাবার ঘর মুছেচ বাসিনী? সব রান্না তুলতে হবে।
    বাসিনী বলে, মুছিচি!
বড়ো বউ হেঁকে বলে, সব হয়ে গেল?
    -মাচের ঘরে সব হলো।

এসব কথা শুনে উচ্ছব বুকে বল পায়। ভাত খাবে সে, ভাত। আগে ভাত খাবে, জিবে ভাতের সোয়াদ নেবে। আসার সময়ে গা-জ্ঞেয়াতি বলেছিল, কলকেতা ঝাচ্চ ঝকন, তখন কালীঘাটে ওদের ছরাদ সেরে দিও। অপঘাতে গেচে ওরা; হ্যাঁ, তাও করবে উচ্ছব, মহানাম শতপতি তো এল না। এলে পরে নদীর পাড়ে সারবন্দি ছরাদ হবে। উচ্ছব কালীঘাটে ছরাদ সারবে। সতীশবাবু বলেছে, উচ্ছবের মতিচ্ছন্ন হয়েছে বই তো নয়। বউ ছেলে মেয়ে অপঘাতে মরল, মানুষ পাগল হয়ে যায়। উচ্ছব ভাত ভাত করচে দেখ।

তুমি কী বুঝবে সতীশবাবু। নদীর পাড়েও থাক না, মেটে ঘরেও থাক না। পাকা ঘর কি ঝড় জলে পড়ে? তোমার ধান চালও পাকা ঘরে রেখেছ। চোর ডাকাতে নেবে না। দেশ জোড়া দুর্যোগেও তোমার রান্না হয়। ভাত খেতে দিলে না উচ্ছবকে। তোকে এগলা দিলে চলবে। তাহলেই পালে পালে পঙ্গপাল জুটবে নে? এ হলো ভগবানের মার। এর চোট থেকে তোকে বাঁচাতে পারি?-তা তুমি ভাত দিলে না, দেশে ভাত নেই। সেই যে পোকায় ধান নষ্ট, সেই হতেই তো উচ্ছবের আধ-পেটা সিকি-পেটা উপোসের শুরু। পেটে ভাত নেই বলে উচ্ছবও প্রেত হয়ে আছে। ভাত খেলে সে মানুষ হবে। তখন বউ ছেলে মেয়ের জন্যে কাদবে। দুঃখ তো ওর হয়নি। ও শুধু পাগল হয়ে বউ মেয়েকে ডেকেছিল কয়েক দিন ধরে। তখনি উচ্ছব প্রেত হয়ে গেছে। মানুষ থাকলে ও ঠিকই বুঝত যে জলের টানে মানুষ ভেসে গেছে। কত গোরু মোষ ভেসে গেল, চল্লুনীর মা তো কোন ছার। উচ্ছব কাঠ কাটা শেষ করে। আড়াই মন কাঠ কাটলো সে ভাতের হুতাশে। নইলে দেহে ক্ষম না।

পাঁচ ভাগে কাঠ রেখে আসে দালানে। উঠোনে কাঠের কুচো, টুকরো সব ঝুড়িতে তুলে উঠোন ঝাঁট দেয়। তারপর বড়ো পিসিমাকে দেখতে পেয়ে শুধোয়, মা। বাইরে ঝেয়ে বসব?

বড়ো পিসিমা তখনই জবাব দেয় না। কেননা তান্ত্রিক হঠাৎ 'ওঁং হ্রীং ঠং ভো ভো রোগ শৃণু শৃণু' বলে গর্জে উঠে রোগকে দাঁড় করান, কালো বেড়ালের লোমে রোগকে বেঁধে ফেলেন ও হোম শুরু করেন। একই সঙ্গে ওপর থেকে নার্স নেমে এসে বলে, ডাক্তারকে কল দিন। -বড়ো মেজো ও ছোটো ঘুম ভাঙা চোখে বিরস মুখে হোমের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, বাসিনী উচ্ছবকে বলে, তুমি ঝেয়ে বাইরে বোসো দাদা। না, মন্তর বললে বটে। ঝেমন হাঁকুড় পাড়লে অমনি কত্তা টাল দিলে? কত্তার দেহ থেকে ব্যাদিটা হাঁচোড় পাঁচোড় করে বেইরে এল। চ্যান করবে তো করে নাও কেন?
    - এখন চান করব না। মাতায় জল পড়লে পেট মানতে চায়নে মোটে।

বাইরে এসে উচ্ছব শিবমন্দিরের চাতালে বসে। কেমন মন্দির, কেমন চাতাল! বাপরে! এসব নাকি বাদার দৌলতে। সে বাদাটা কোথায় থাকে? ভাত তো খায়নি উচ্ছব অনেক দিন। ভাত খেয়ে দেহে শক্তি পেলে উচ্ছব সেই বাদাটা খুঁজে বের করবে। উচ্ছবের মতো আরো কত লোক আছে দেশে। তাদেরও বলবে।

মন্দিরের চাতালে ভাস পেটে তিনটি ছেলে। তারা বলে, বুড়োকে বাঁচিয়ে তুলতে হোম হচ্ছে।
    - ফালতু ?
    - কী ফালতু ?
    - বেঁচে থেকে ও কত দিন জীবন পাবে। একশো? যত সব ফালতু।

উচ্ছব চোখ বোজে। এমন যোগীর পরেও বুড়ো কর্তা বেশিদিন বাঁচবে না? কী কাণ্ড! মাতলা নদী যদি সে রাতে পাগল হয়ে মাতাল মাতনে উঠে না আসে তো উচ্ছবের বউ, চুন্নুনী, ছোটো খোকা অনেকদিন বেঁচে। উচ্ছবের চোখের কোলে জল গড়ায়। ভাত খাবে আজ। সেই আশাতেই প্রেত উচ্ছব মানুষ হয়ে গেল নাকি? বড়ো ছেলে ছোটো খোকার কথা মনে হতে চোখে জল এল হঠাৎ? ভাতই সব। অন্ন লক্ষ্মী, অন্ন লক্ষ্মী, অন্নই লক্ষ্মী, ঠাগমা বলত। ঠাগমা বলত, রন্ন হল মা নকী।

    - কী হে কানছ কেন?
    - আমারে শুদোচ্ছেন বাবু ?
    - হাঁ হে।
    - আবাদ থেকে আসতেছি বাবুগো। ঝড়ে জলে সব নাশ হয়ে, ঘরের মানুষ…
    -ও!

তাস পিটানো ছেলেগুলি অস্বস্তিতে পড়ে। বয়স্ক ছেলেটি বলে, ঠিক আছে ভাই ঘুম এসো।

উচ্ছব সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমিয়েই থাকে সে অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ। অবশেষে কার পায়ের ধাক্কা খেয়ে শেষে ঘুম ভাঙে তার।

ইস! এ যে সাঁঝ বেলা গো। কিন্তু তাকে ঠেলা দিচ্ছে কেন লোকটা।
    - ওঠো, ওঠো কে তুমি?
    - বাবু...আমি…
    - চুরির মতলবে পড়ে আছো?
    - না বাবু, এই বাড়িতে কাজ করতেছিলাম।
    -ওঠো, ওঠো।

উচ্ছব উঠে পড়ে। তারপর সে অত্যন্ত ঘাবড়ে যায়। রাস্তায় বেশ কয়েকটি গাড়ি। লোকের ছোটো ছোটো জটলা।
    - কী হয়েছে বাবু ?

কেউই তার কথায় জবাব দেয় না। উচ্ছব বাড়িতে ঢোকে। ঢুকতেই বড়ো পিসিমার বিলাপ শোনে, তোমার ছোটো বেয়াই কি ডাকাতে সন্নেসী আনল গো দাদা! যোগী হলো আর তুমিও মল্লে! অ-দাদা। তুমি যে বিরেশিতে যাবে তা কে জানত বল গো! তোমার যে আটানব্বই বচর বেঁচে থাকার কথা গো দাদা!

বাসিনীকে দেখতে পায় না উচ্ছব। তবে খুব কর্মব্যস্ততা দেখে। কেত্তন না এলে বেরুনো নেই। কে যেন বলে।
    - কেত্তন কী বলছিস বড়ো খোকা। বোনরা, দিদিরা আসুক। বড়ো পিসিমা বলেন। চন্নন বটছ কেউ?
    - খাটের টাকা কে নিয়েছে?
    - বাগবাজারে, ফোন করচ?
    - ফর্দা দেকে দাও দিকি কেউ। খই, ফুল, ধুতি। শ বস্তর...উত্তর পাঁচিলের গায়ে সিঁটিয়ে লেপটে দাঁড়িয়ে থাকে। কত যে সময় যায়, কত কী যে হতে থাকে।

মস্ত খাট আসে। রাতে রাতে বের কতে হবে। রাতে রাতে কাজ সারতে হবে। নইলে দোষ লাগবে।

অনেক তোড়জোড় হয়। মেয়েরা বসে কাঁদে। হোম যজ্ঞা করেও বুড়ো কত্তার প্রাণটা যে রইল না, তাতে তান্ত্রিককে এতটুকু কুণ্ঠিত দেখা যায় না। তিনি লাইন করে ফেলেন তাঁর। ফলে বড়ো পিসিমা চেঁচিয়ে বলতে থাকেন, তিন ছেলে হোম ছেড়ে উঠে গেল যে?

এসব কাজে বিঘ্নি পড়লে বক্ষে আছে?-একথার আলোচনায় খুব সরগরম হয় বাড়ি। শোকের কোনো ব্যাপার থাকে না। বাড়ির উনুনই জ্বলবে না। রাস্তার দোকান থেকে চা আসতে থাকে। অবশেষে রাত একটার পর বুড়ো কত্তা বোম্বাই খাটে শুয়ে নাচতে নাচতে চলে যান। পেশাদারি দক্ষ শববাহকরা আধা দৌড় দেয়। ফলে কীর্তন দলও দৌড়তে বাধ্য হয়। বড়ো পিসিমা বলেন, বাসিনী, সবস্ব রান্না পথে ঢেলে দিগে যা। ঘরদোর মুক্ত কর সব। বউরা যাও না। দাঁড়িয়ে বা রইলে কেন?

উচ্ছবের মাথার মধ্যে যে মেঘ চলছিল তা সরে যায়। সে বুঝতে পারে সব ভাত ওরা পথে ফেলে দিতে যাচ্ছে।

বাসিনী বলে, ধর দেখি দাদা।
    - এই যে ধরি!

উচ্ছবের মাথায় এখন বুদ্ধি স্থির, সে জানে সে কী করবে।
    - আমাকে দে ভারিটা।

মোটা চালের ভাতের বড়ো ডেকচি নিয়ে সে বলে, দূরে ফেলে দে আসি।
    - হ্যাঁ হ্যাঁ লয়তো কুকুরে ছেটাবে, সকালে কাকে ঠোক দোবে—বামুন বলে।

বেরিয়ে এসে উচ্ছব হনহনিয়ে হাঁটতে থাকে। খানিক হেঁটে সে আধা দৌড় মারে। ভাত, বাদার ভাত তার হাতে এখন। পথে ঢেলে দেবে? কাক-কুকুরে খাবে?
    - দাদা।-ত্রস্থ বাসিনী প্রায় ছুটে আসে, অশুচ বাড়ির ভাত খেতে নি দাদা।
    - খেতে নি? তুমিও ঝেয়ে বামুন হয়েছ?
    - অ দাদা ব্যাগ্যতা করি—

উচ্ছব ফিরে দাঁড়ায়। তার চোখ এখন বাদার কামটের মতো হিংস। দাঁতগুলো বের করে সে কামটের মতোই হিংস্র ভঙ্গি করে। বাসিনী থমকে দাঁড়ায়।

উচ্ছব দৌড়তে থাকে। প্রায় এক নিশ্বাসে সে স্টেশনে চলে যায়। বসে ও খাবল খাবল ভাত খায়। ভাতে হাত ঢুকিয়ে দিতে সে স্বর্গ সুখ পায় ভাতের স্পর্শে। চুন্নুনীর মা কখনো তাকে এমন সুখ দিতে পারেনি। খেতে খেতে তার যে কী হয়। মুখ ডুবিয়ে দিয়ে যায়। ভাত, শুধু ভাত। বাদার ভাত। বাদার ভাত খেলে তবে তো সে আসল বাদাটার খোঁজ পেয়ে যাবে একদিন। আছে, আরেকটা বাদা আছে। সে বাদাটার খোঁজ নির্ঘাত পাবে উচ্ছব। আরো ভাত খেয়ে নি। চুন্নুনী রে! তুইও খা, চুন্নুনীর মা খাও, ছোটো খোকা যা, আমার মধ্যে বসে তোরাও খা। আঃ! এবার জল খাই, জল! তারপর আরো ভাত। ভোরের টেনে চেপে বসে সোজা ক্যানিং যাচ্ছি। ভাত পেটে পড়েছে এখন ঝা নচি ঝে ক্যানিং হয়ে দেশঘরে যেতে হবে।

উচ্ছব হাঁড়িটি জাপটে কানায় মাথা ছুঁইয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

 
পেতলের ডেকচি চুরি করার অপরাধে সকালে লোকজন উচ্ছবকে সেখানেই ধরে ফেলে। পেটে ভাতের ভার নিয়ে উচ্ছব ঘুমিয়েছিল, ঘুম তার ভাঙেনি।

মারতে মারতে উচ্ছবকে ওরা থানায় নিয়ে যায়। আসল বাদাটার খোঁজ করা হয় না আর উচ্ছবের। সে বাদাটা বড়ো বাড়িতে থেকে যায় অচল হয়ে।
--------xx-------

এই গল্পের প্রশ্ন ও উত্তর পেতে এখানে ক্লিক করো।  


মন্তব্যসমূহ

বাংলা বই : দ্বাদশ শ্রেণি - সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রশ্নোত্তর

বাংলা বই : দ্বাদশ শ্রেণি । প্রশ্ন ও উত্তর

বাংলা বই - দ্বাদশ শ্রেণি উচ্চমাধ্যমিক 'বাংলা বই'য়ে👨তোমাকে স্বাগত 💁 তোমার প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরটি পেতে ওপরের মেনু বারের বিষয় মেনুতে ক্লিক করো । গল্পের প্রশ্ন চাইলে ‘ গল্পের  প্রশ্ন’  ট্যাবে , কবিতার প্রশ্ন চাইলে ‘ কবিতার প্রশ্ন’ ট্যাবে ক্লিক করো ।  এভাবে প্রয়োজনীয় বিষয়ের  ট্যাবে  ক্লিক করে প্রশ্নের পাতায় যাও। সেখানে দেওয়া নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রশ্ন ও উত্তর খোঁজ। অথবা নিচের প্রয়োজনীয় লিঙ্কে ক্লিক করো। সকলের জন্য শুভকামনা রইল। বিভিন্ন প্রশ্ন ও উত্তর পেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করো। ১)  দ্বাদশ শ্রেণির গল্প 👉   প্রশ্ন ও উত্তর ২)  দ্বাদশ শ্রেণির কবিতা 👉   প্রশ্ন ও উত্তর ৩)  দ্বাদশ শ্রেণির নাটক 👉   প্রশ্ন ও উত্তর ৪)  আন্তরজাতিক কবিতা ও ভারতীয় গল্প 👉   প্রশ্ন ও উত্তর ৫)  দ্বাদশ শ্রেণির পূর্নাঙ্গ সহায়ক গ্রন্থ  👉  প্রশ্ন ও উত্তর ৬)  দ্বাদশ শ্রেণির শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস 👉   প্রশ্ন ও উত্তর ৭)  দ্বাদশ শ্রেণির ভাষা বিভাগ 👉   প্রশ্ন ও উত্তর   ৮)  দ্বাদশ শ্রেণির প্রবন্ধ  👉   প্রবন্ধের তালিকা ৯)  দ্বাদশ শ্রেণির প্রুফ সংশোধন  👉   নমুনা প্রশ্ন ও উত্তর ১

দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের কবিতা

দিল্লী, তুমি এমন হলে কেন? দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের কবিতা  শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের কবিতা Poems of Bahadur Shah Zafar II রেশমখানি অঙ্গে ধরে তব ধাঁধিয়েছিলে আমার দুটি চোখ, আধফোটা ফুল হৃদয়কমলতলে এই ঋতুরাজ তোমার সঙ্গী হোক। প্রাণের সাথে চলে প্রাণের খেলা তেমনি ছিলে ঘ্রাণের মত মোর সময় হলে সবার যেতে হয়- তুমিও গেলে ভেঙে সুখের দোর। অধর ছুঁয়ে অধর কথা বলে হৃদয় জানে ব্যথার গোপন সুর পাছে তোমার ভালবাসায় পড়ি তোমায় ছেড়ে যাচ্ছি বহু দূর আশার আলো নিভছে চিরতরে মনকে আমি বোঝাই নাকো আর ধুলোয় ছিলাম, ধুলোয় ফিরে যাব আমায় আজ কারই বা দরকার? দিল্লী তুমি আমার দেবপুরী আদর যেন বইত হাওয়ার ভেলা এখন তুমি জ্বলতে থাকা চিতা জমতে থাকা কান্না, অবহেলা। রাস্তা জুড়ে শবের স্তুপ জমে চোখের জল শুকিয়ে গেছে যেন মৃতেরা সব নেই তো কোনখানে দিল্লী, তুমি এমন হলে কেন? ছিন্ন হৃদয়, ছিন্ন মাংস-হাড় মনন জ্বলে দীর্ঘ সব শ্বাসে রক্তপুরী, সব হারাদের দেশ আমার চোখ সজল হয়ে আসে। চিরটাকাল সঙ্গে কে আর থাকে? সবার ভাগ্যে সব ভাল কি সয়? মনে ভাবি পরম নবীর বাণী সকল কিছু ভালোর জন্য হয়। অনুবাদ করেছেন কৌশিক মজুমদার

ভারতের জাতীয় সংহতি ও বিছিন্নতাবাদ

ভারতের জাতীয় সংহতি ও বিছিন্নতাবাদ নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান্ — অতুল প্রসাদ সেন  ভূমিকা : জাতীয় সংহতি হল একটি দেশের নাগরিকদের মধ্যে একটি সাধারণ পরিচয় সম্পর্কে সচেতনতা। এর অর্থ হল, আমাদের মধ্যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ এবং ভাষাগত পার্থক্য থাকলেও, আমরা এই সত্যকে স্বীকার করি যে, আমরা সবাই এক। এটি কেবল একটি জাতীয় অনুভূতি নয়, এটা সেই চেতনা যা সমস্ত উপভাষা ও বিশ্বাসের মানুষকে একই প্রচেষ্টায় একত্রিত করে। জাতীয় একীকরণের সংজ্ঞা: ডাঃ এস. রাধাকৃষ্ণ বলেছেন, national integration cannot be made by bricks and mortar, mould and hammer, but it quietly grows in people’s minds through education.1️⃣ এইচ এ গণি সংজ্ঞায়িত করেছেন, “National integration is a socio-psychological and educational process through which a feeling of unity and harmony develops in the hearts of the people and a sense of common citizenship or feeling of loyalty to the nation is fostered among them”2️⃣ এককথায়, জাতীয় সংহতির ধারণার মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক

নিখিলের চরিত্র বিশ্লেষণ

নিখিলের চরিত্র বিশ্লেষণ  নিখিলের চরিত্র বিশ্লেষণ 'কে বাঁচায়, কে বাঁচে' গল্প অবলম্বনে নিখিল চরিত্রের বিশ্লেষণ করো। নিখিলের চরিত্র বিশ্লেষণ সূচনা : মার্কসবাদী কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পে নিখিল একজন সহযোগী চরিত্র। সম্পর্কে কেন্দ্রীয় চরিত্র মৃত্যুঞ্জয়ের সহকর্মী ও বন্ধু। কথকের বর্ণনায় সে একজন ‘রোগা, তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং একটু অলস প্রকৃতির লোক’। বন্ধু বৎসল মানুষ : তবে নিখিল অত্যন্ত বন্ধুবৎসল মানুষ। তাই সে মৃত্যুঞ্জয়কে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে তার ভাবনায় অসঙ্গতি কোথায়। শুধু তাই নয়, নানাভাবে সে মৃত্যুঞ্জয় ও তার পরিবারের পাশে থাকে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। আন্তরিক ও মানবিক : নিখিল আবেগ অনুভূতিহীন মানুষ নয়। নিরন্ন মানুষের অসহায় মৃত্যু এবং কিছু না করতে পারার যন্ত্রণায় যখন মৃত্যুঞ্জয়ের চোখ ছল ছল করে ওঠে, তখন নিখিলের মনটাও খারাপ হয়ে যায়। মানুষের প্রতি আন্তরিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের কারণেই সে প্রতি মাসে তিন জায়গায় নিয়মিত অর্থ সাহায্যও পাঠায়। যুক্তিবাদী চিন্তা: তবে নিখিল অত্যন্ত যুক্তিবাদী। সে জানে, রিলিফ মানে আসলে একজন

বাংলার ঋতুরঙ্গ বা বাংলা ঋতু বৈচিত্র্য

 বাংলার ঋতুরঙ্গ বা ঋতু বৈচিত্র্য বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর। — জীবনানন্দ দাস ভূমিকা : ঋতুবৈচিত্র্যের বর্ণিল উপস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রকৃতি পরিপূর্ণ। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা এই বাংলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর বৈচিত্র্যময় ঋতুরূপ। ভিন্ন ভিন্ন রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে পর্যায়ক্রমে ছয়টি ঋতু ঘুরে ফিরে আসে এই বাংলায়। প্রতিটি ঋতুই স্বতন্ত্র সৌন্দর্যে অপরূপা। বাংলা প্রকৃতির এই অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে জীবনানন্দ দাশ একে ‘ রূপসী বাংলা ’ বলে অভিহিত করেছেন। ঋতু বৈচিত্রের কারণ : বাংলাদেশ  কর্কটক্রান্তি রেখার ওপর অবস্থিত। এখানকার আবহাওয়াতে তাই নিরক্ষীয় প্রভাব দেখা যায়। এখানেই রয়েছে বাংলার ঋতু বৈচিত্রের মূল চাবিকাঠি।  নভেম্বর হতে মার্চ পর্যন্ত এখানে হালকা শীত অনুভূত হয়। মার্চ হতে জুন মাস পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল চলে। জুন হতে অক্টোবর পর্যন্ত চলে বর্ষা মৌসুম। এসময় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে হয় প্রচুর বৃষ্টিপাত। ছয় ঋতুর ‘রূপসী বাংলা’ : বাংলার এই ছটি ঋতু যেন বিনি সুতোয় গাঁথা মালার মতো। এই মেলায় পর পর গাঁথা আছে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও ঋতুরাজ বসন্ত। প্রতি দুই মাস অন্তর

কবিতা : পড়তে জানে এমন এক মজুরের প্রশ্ন - বের্টোল্ট ব্রেখট

‘পড়তে জানে এমন এক মজুরের প্রশ্ন’ - বের্টোল্ট ব্রেখট পড়তে জানে এমন এক মজুরের প্রশ্ন - বের্টোল্ট ব্রেখট বের্টোল্ট ব্রেখ্ট কে বানিয়েছিল সাত দরজাঅলা থি? বইয়ে লেখে রাজার নাম। রাজারা কি পাথর ঘাড়ে করে আনত? আর ব্যাবিলন এতবার গুঁড়ো হল, কে আবার গড়ে তুলল এতবার? সোনা- ঝকঝকে লিমা যারা বানিয়েছিল তারা থাকত কোন বাসায়? চিনের প্রাচীর যখন শেষ হল সেই সন্ধ্যায় কোথায় গেল রাজমিস্ত্রিরা? জয়তোরণে ঠাসা মহনীয় রোম। বানাল কে? কাদের জয় করল সিজার? এত যে শুনি বাইজেনটিয়াম, সেখানে কি সবাই প্রাসাদেই থাকত? এমনকী উপকথার আটলান্টিস, যখন সমুদ্র তাকে খেল ডুবতে ডুবতে সেই রাতে চিৎকার উঠেছিল ক্রীতদাসের জন্য। ভারত জয় করেছিল তরুণ আলেকজান্ডার। একলাই না কি? গলদের নিপাত করেছিল সিজার। নিসেন একটা রাঁধুনি তো ছিল? বিরাট আর্মাডা যখন ডুবল স্পেনের ফিলিপ কেঁদেছিল খুব। আর কেউ কাঁদেনি? সাত বছরের যুদ্ধ জিতেছিল দ্বিতীয় ফ্রেডারিক। কে জিতেছিল? একলা সে? পাতায় পাতায় জয় জয়োৎসবের ভোজ বানাত কারা? দশ-দশ বছরে এক-একজন মহামানব খরচ মেটাত কে? কত সব খবর! কত সব প্রশ্ন! -------xx------ 📔 এই কবিতার প্রশ্নোত্তর পেতে এখানে ক্লিক করো । ভাষান্ত

ছোটগল্প হিসেবে 'কে বাঁচায়, কে বাঁচে' গল্পটির সার্থকতা বিচার

ছোটগল্প হিসেবে 'কে বাঁচায়, কে বাঁচে' গল্পটির সার্থকতা বিচার : ছোটগল্প হিসাবে ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ কতটা সার্থক ছোটগল্প হিসেবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কে বাঁচায়, কে বাঁচে' গল্পটি কতটা সার্থক হয়েছে আলোচনা করো। ছোটগল্প হিসাবে ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ কতটা সার্থক 👉 ভূমিকা : ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা নিতান্ত সহজ সরল, ........ অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে শেষ হয়ে হইল না শেষ। কথাগুলো বলেছিলেন বাংলা ছোটগল্পের সার্থক রূপকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । কবিতার ছন্দে বলা এই অংশতেই রয়েছে সার্থক ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যে র যথাযথ বিবরণ। এডগার অ্যালান পো -এর মতে, যে গল্প অর্ধ থেকে এক বা দুই ঘণ্টার মধ্যে এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়, তাকে ছোটগল্প বলে। ছোটগল্পে জীবনের সামগ্রিক দিকটি উপন্যাসের মতো বিস্তারিতভাবে বর্ণিত না হয়ে, তার খণ্ডাংশ নিয়ে পরিবেশিত হয়। এজন্য ছোটগল্প যথাসম্ভব বাহুল্যবর্জিত, রসঘন ও নিবিড় হয়ে থাকে। সংগত কারণেই এতে চরিত্রের সংখ্যা হয় খুবই সীমিত। ছোটগল্পের প্রারম্ভ ও প্রাক্কাল সাধারণত এবং খানিকটা নাটকীয়ভাবেই শুরু হয়। 👉   ছোটগল্পের বৈশ

অমৃতের পুত্র মানুষ

“অমৃতের পুত্র মানুষ।” অমৃতের পুত্র মানুষ ক) কোন্ প্রসঙ্গে লেখক এর এই উক্তি? খ) ‘অমৃতের পুত্র’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? গ) এই মানুষটির (অমৃতের পুত্র) বর্ণনা দাও। ঘ) এই উক্তির মাধ্যমে লেখক কী বোঝাতে চেয়েছেন? অথবা , এই উক্তির তাৎপর্য কী? অথবা , এই উক্তির মধ্য দিয়ে লেখকের কোন্ মনোভাব ফুটে উঠেছে? ক) কোন্ প্রসঙ্গে লেখক এর এই উক্তি? সমাজ সচেতন প্রাবন্ধিক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘আমার বাংলা’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে নেওয়া ‘হাত বাড়াও’ রচনা থেকে উদ্ধৃত অংশটি গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রবন্ধে কথিত রাজবাড়ীর বাজার থেকে ফরিদপুরে ফেরার জন্য লেখক স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ একটু দূরে স্টেশনের রাস্তায় মিলিটারি ছাউনির পাশে একটা অদ্ভুত জন্তু দেখতে পান। অদ্ভুত এই জন্তু যেন চার পায়ে ভর দিয়ে এগিয়ে আসছে। আরো একটু এগিয়ে এলে তিনি দেখতে পান রাস্তার ধুলো থেকে সে কী যেন খুঁটে খাচ্ছে। ঠিক মানুষের হাতের মতো তার সামনের থাবা দুটো। আঙুলগুলো বড্ড বেশি সরু। গায়ে এক ফোটা লোম নেই। একটু পরে, সামনাসামনি আসতেই তিনি স্তম্ভিত হয়ে আবিষ্কার করেন —এটা কোন জন্তু নয়, একজন মানুষ। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখা এবং স্তম্ভিত হয়ে যাবার

সহমরণ — সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

সহমরণ — সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সহমরণ — সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ‘জিজ্ঞাসি’ছ পড়া কেন গা’? শুনিবে তা’? — শোন তবে মা — দুখের কথা ব’ল্ ব কা’রে বা! ************************* জন্ম আমার হিদুঁর ঘরে, বাপের ঘরে, খুব আদরে, ছিলাম বছর দশ; কুলীন পিতা, কুলের গোলে, ফেলে দিলেন বুড়ার গলে; হ’লাম পরের বশ। আচারে তার আস্ ত হাসি, — ব’লব কি আর পরকাশি, — মিটল সকল সাধ; — হিঁদুর মেয়ে অনেক ক’রে শ্রদ্ধা রাখে স্বামীর ’পরে তা’তেও বিধির বাদ। বুড়াকালের অত্যাচারে,— শয্যাশায়ী ক’রলে তা’রে জেগেই পোহাই রাতি; দিন কাটেত’ কাটে না রাত, মাসের পরে গেল হঠাৎ, — নিবল জীবন বাতি। ********************** কতক দুঃখে, কতক ভয়ে শরীর এল অবশ হ’য়ে ভাঙল সুখের হাট খ’য়ের রাশি ছড়িয়ে পথে, চল্ ল নিয়ে শবের সাথে,— যেথায় শ্মশান ঘাট। গুঁড়িয়ে শাঁখা, সবাই মিলে, চিতায় মোরে বসিয়ে দিলে, বাজ্ ল শতেক শাঁক; লোকের ভিড়ে ভরেছে ঘাট, ধুঁইয়ে উঠে চিতার কাঠ, উঠ্ল গর্জ্জে ঢাক। ******************** রোমে, রোমে, শিরায়, শিরায়, জ্বালা ধরে, —প্রাণ বাহিরায়,— মরি বুঝি ধোঁয়ায় এবার! আচম্বিতে—চিৎকার রোলে— চিতা ভেঙে, পড়িলাম জলে, মাঝি এক নিল নায়ে তার। যত লোক করে ‘মার

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

প্রবন্ধ রচনা : মাইকেল মধুসূদন দত্ত ভূমিকা: মাইকেল মধুসূদন দত্ত একাধারে একজন মহাকবি, নাট্যকার, বাংলাভাষার সনেট প্রবর্তক ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে, এক জমিদার বংশে তাঁর জন্ম। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল। মায়ের নাম জাহ্নবী দেবী। শিক্ষাজীবন : মধুসূদন দত্ত শিক্ষা গ্রহণ পর্ব শুরু হয় মায়ের তত্ত্বাবধানে সাগরদাঁড়ির পাঠশালায়। পরে সাত বছর বয়সে কলকাতা আসেন এবং খিদিরপুর স্কুলে দুবছর পড়ার পর ১৮৩৩ সালে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষা শেখেন।  এখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক প্রমুখ, যাঁরা পরবর্তী জীবনে স্বস্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। কলেজের পরীক্ষায় তিনি বরাবর বৃত্তি পেতেন। এ সময় নারীশিক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। এ সময় থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন বিলেত যাওয়ার। তাঁর ধারণা ছিল বিলেতে যেতে পারলেই বড় কবি হওয়া যাবে।  এই উদ্দেশ্যেই ১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি খ্রিস্ট ধর্ম গ্র