“কিন্তু আজও সেই দুটো জ্বলন্ত চোখ আমাকে থেকে থেকে পাগল করে।”
কিন্তু আজও সেই দুটো জ্বলন্ত চোখ আমাকে থেকে থেকে পাগল করে |
খ) তার শারীরিক বর্ণনা দাও।
গ) বক্তার এই মানসিক অবস্থার কারণ বিশ্লেষণ করো।
অথবা,
সেই চোখ দুটো বক্তাকে পাগল করে কেন?
ক) চোখ দুটি কার?
সমাজ সচেতন প্রাবন্ধিক তথা লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘আমার বাংলা’ গ্রন্থ থেকে গৃহীত ‘হাত বাড়াও’ রচনা থেকে উদ্ধৃত অংশটি নেওয়া হয়েছে।
এই রচনায় লেখক একটি কঙ্কালসার দেহবিশিষ্ট ১২-১৩ বছর বয়সী উলঙ্গ কিশোরের বর্ণনা দিয়েছেন, যে পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের সময় রাস্তা থেকে চাল ও ছোলা কুড়িয়ে খেতে দেখেছেন। এখানে বর্ণিত ‘চোখ দুটি’ হল এই উলঙ্গ ছেলেটির।
খ) তার শারীরিক বর্ণনা দাও।
এই ছেলেটি আসলে একটি ১২-১৩ বছরের উলঙ্গ কিশোর, যার দীর্ঘদিন অনাহারে থাকতে থাকতে মাজা পড়ে গেছে। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়েছে। হাঁটতে পারে না, তাই জন্তুর মতো চার হাত-পায়ে চলে। পাতলা কুয়াশার মধ্যেও জ্বলজ্বল করছিল তার চোখ দুটো। লেখকের বর্ণনায়,
একা থাকলে ভয়ে মূর্ছা যেতাম। কেননা সেই চোখের দৃষ্টিতে এমন এক মায়া ছিল, যা বুকের রক্ত হিম করে দেয়।
তার আঙুলগুলো অসম্ভব সরু। দেখতে লোমহীন কোনো অচেনা জন্তুর মতো। রাস্তার ধুলো থেকে সে মাটিতে পড়ে থাকা চাল আর ছোলা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। প্রথম দেখাতেই লেখকের মনে হয়েছিল সে যেন অচেনা কোন এক ‘অদ্ভুত জন্তু’। কিন্তু সামনাসামনি আসতেই তিনি স্তম্ভিত হয়ে আবিষ্কার করেন —এটা কোন জন্তু নয়; সে আসলে ‘অমৃতের পুত্র মানুষ’।
গ) বক্তার এই মানসিক অবস্থার কারণ বিশ্লেষণ করো।
অথবা,
সেই চোখ দুটো বক্তাকে পাগল করে কেন?
আসলে সুভাষ মুখোপাধ্যায় হলেন একজন মার্কসবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী বামপন্থী লেখক। তিনি আজীবন শ্রেণি বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত এক মানব সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন। তাঁর সমগ্র লেখক সত্তা জুড়েই রয়েছে এই মানবিক মূল্যবোধের উজ্জ্বল উপস্থিতি।
আর এ কারণেই রাজবাড়ীর বাজারে বসে যে অদ্ভুত জন্তুর মত উলঙ্গ কিশোরকে তিনি দেখেছিলেন, তা তাকে স্তম্ভিত ও আতঙ্কিত করে তোলে। ফলে তৎক্ষণাৎ তিনি সেই স্থান ত্যাগ করেন, লেখকের কথায় তিনি ‘পালিয়ে’ আসেন।
কিন্তু পালিয়ে এলেও তিনি বিবেকের দংশন থেকে মুক্ত হতে পারেননি। কারণ, তিনি জানতেন এই ছেলেটিই এই সমাজের একমাত্র ব্যতিক্রম নয়। এই সমাজে অসংখ্য মানুষ এভাবেই অমানবিক জীবন যাপন করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জনিত ভয়াবহ আর্থিক সংকট, ইংরেজ সরকারের লাগামহীন শাসন ও শোষণ, সরকারের উদাসীনতায় বেড়ে ওঠা জোতদার, মজুতদার ও মহাজনদে সীমাহীন লোভ, নিরন্ন মানুষের প্রতি উচ্চবিত্ত মানুষের উদাসীনতা এবং মধ্যবিত্তের স্বার্থপর মানসিকতায় এই ভয়ংকর পরিস্থিতির জন্ম নিয়েছে। তিনি ভুলে থাকতে পারেননি, তিনি নিজেও এই সমাজেরই একজন। আর এখান থেকেই জন্ম নিয়েছে বিবেকের দংশন। আর এ কারণেই ছেলেটির দুটো জ্বলন্ত চোখ তাকে থেকে থেকে পাগল করে তোলে। বস্তুত, সবকিছু জেনে বুঝেও এই অসহায় মানুষগুলোর জন্য কিছু না করতে পারার সীমাহীন যন্ত্রনা ফুটে উঠেছে তাঁর এই লেখনীর মধ্য দিয়ে।
---------xx---------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন