“বহুদিন জঙ্গলে কাটেনি দিন / বহুদিন জঙ্গলে যায়নি”
ক) কেন কবি একথা বলেছেন?
অথবা,বহুদিন জঙ্গলে যাননি বলে কবি কেন আক্ষেপ করেছেন?
খ) কবি কেন জঙ্গলে যেতে চান বুঝিয়ে বলো।
গ) এই অভাব পূরণের জন্য কবি কী চেয়েছেন?
ঘ) বহুদিন জঙ্গলে না যাওয়ার সঙ্গে বহুদিন শহরে থাকার সম্পর্কটি নিরূপণ করো।
ক) একথা বলার কারণ (আক্ষেপের কারণ) :
প্রকৃতি প্রেমিক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘আমি দেখি’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত অংশটি নেওয়া হয়েছে।
এই কবিতায় আমরা তাকে দেখতে পাই গাছ-প্রেমিক এক নাগরিক কবি হিসাবে। অর্থাৎ নাগরিক কবি হলেও তিনি ছিলেন অরণ্য প্রেমি। কারণ, তিনি জানতেন অরণ্যের সবুজের মধ্যেই রয়েছে শহরে জীবনের যান্ত্রিক ও কৃত্রিম পরিবেশে হাঁপিয়ে ওঠা নাগরিকের জন্য সঞ্জীবন সুধা।
আর এ কারণেই তিনি বারবার যেতে চান অরণ্যভূমি সবুজ আঁচলের মায়াবী ছায়ায়। কিন্তু দীর্ঘ অসুস্থতা ও নাগরিক জীবনের ব্যস্ততায় দীর্ঘদিন তিনি তা ছুঁতে পারেননি। তাই ইচ্ছা পূরণ না হওয়ার বেদনায় তিনি হতাশ হয়েছেন। সেই হতাশার কারণেই তিনি উদ্ধৃত মন্তব্যটি করেছেন।
খ) জঙ্গলে যেতে চাওয়ার কারণ :
অরণ্যের গভীর সবুজে দীর্ঘদিন অনুপস্থিতির (দীর্ঘ অসুস্থতা ও নাগরিক জীবনের ব্যস্ততায়) কারণে তৈরি হওয়া এই হতাশা কবিকে উদগ্রীব করে তোলে। সবুজের সান্নিধ্যে গিয়ে বুক ভোরের শ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে প্রাত্যহিক জীবনের ক্লান্তি অবসাদ ও রিক্ততা থেকে মুক্তি পাওয়ার তাগিদে কবি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। কারণ, তিনি জানতেন,
আরোগ্যের জন্য ওই সবুজের ভীষণ দরকার
ফলে চোখ, দেহ এবং মন জুড়ে তৈরি হয় সবুজের প্রতি অদম্য টান। কবির কথায়,
চোখ তো সবুজ চায়
দেহ চায় সবুজ বাগান
অরণ্যের প্রতি এই টানকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা কবির নেই। আর সে কারণেই তিনি জঙ্গলে ছুটে যেতে চান।
গ) অভাব পূরণে কবির চাওয়া?
একদিকে শারীরিক অসুস্থতা ও নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা, অন্যদিকে জঙ্গলের সবুজ ঘেরা পরিবেশের প্রতি অদম্য টান কবির মনে এক শূন্যতা তৈরি করে। এই শূন্যতার কারণেই মনের গহীনে জমতে থাকে সবুজের অভাবজনিত খেদ। আর এই অভাব বা খেদ পূরণের জন্য তিনি জঙ্গলের সবুজকে তুলে আনতে চেয়েছিলেন ইট-কাঠ-পাথরে ঘেরা শহুরে আঙ্গিনায়। কবি তাই মৃদু নির্দেশের ভঙ্গিতে সহ-নাগরিক তথা বিশ্ব নাগরিক সমাজের কাছে আবেদন করেন কবিতার সূচনায়।
গাছগুলো তুলে আনো, বাগানে বসাও
আমার দরকার শুধু গাছ দেখা
কবির এই চাওয়ার পিছনে যে দুটি যৌক্তিক কারণ রয়েছে তা উল্লেখ করতেও তিনি ভোলেননি। প্রথম স্তবকে বলেছেন :
গাছের সবুজ টুকু শরীরে দরকার
আরোগ্যের জন্য ওই সবুজের ভীষণ দরকার
দ্বিতীয় স্তবকে বলছেন অপরিকল্পিতভাবে নগরায়নের ফলে ঘটা ‘সবুজের অনটনে’র কথা।
শহরের অসুখ হা করে কেবল সবুজ খায়
সবুজের অনটন ঘটে...
সবুজের এই অনটন বা অভাব মেটাতে তাই পুনরায় আবেদন করেন। নির্দ্বিধায় তার চাওয়াকে উপস্থাপন করেন নাগরিক সমাজের কাছে। তাঁর কথায় :
তাই বলি, গাছ তুলে আনো
বাগানে বসাও আমি দেখি
বস্তুত বহুদিন জঙ্গলে যেতে না-পারাজনিত অভাব বা খেদ পূরণের জন্য তিনি শহর জুড়ে বৃক্ষরোপণের আয়োজন চেয়েছেন ‘আমি দেখি’ কবিতায়।
ঘ) জঙ্গলে না যাওয়ার সঙ্গে শহরে থাকার সম্পর্ক।
কবির বহুদিন জঙ্গলে না যাওয়ার সঙ্গে বহুদিন শহরে থাকার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কবি নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত হলেও তিনি জানতেন মানুষের জীবনের সঙ্গে বনবৃক্ষের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। এই সম্পর্ক শুধু খাদ্যখাদকের নয়, শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গেও জড়িত। এই সম্পর্কই সারা জীবন ধরে নাগরিক কবিকে বারবার জঙ্গলমুখী করে তুলেছে।
কিন্তু নগর জীবনের ব্যস্ততা ও দূষণ কবিকে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত সর্বোপরি রোগাক্রান্ত করে তুলেছে। আর এ কারণেই কবির সঙ্গে জঙ্গলের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মন চাইলেও কবির শরীর জঙ্গলমুখী হতে দিচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই উভয়ের স্বাভাবিক সম্পর্ক তার ধারাবাহিকতা হারিয়ে ফেলে উল্টোমুখী হয়ে উঠেছে। এই আক্ষেপ থেকেই জন্ম নিয়েছে শহরকে সবুজ বাগানে মুড়ে ফেলার ভাবনা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন