হাত বাড়াও
সু ভা ষ মু খো পা ধ্যা য়
হাত বাড়াও : সু ভা ষ মু খো পা ধ্যা য় |
শীতকালে শুধু পায়ের পাতাটুকু ডোবে এমন নদী তিস্তা। হেঁটে পার হবার সময় পেছনে যদি তাকাও দেখবে আকাশের পিঠে পিঠ রেখে হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে আছে প্রকাণ্ড এক দৈত্য। আসলে দৈতা নয়, হিমালয়া পাহাড়।
নন্দীগ্রামের এক অখ্যাত গাঁয়ে নোনা-লাগা তালগাছের বন পেরিয়ে আকাশের কোলের কাছে প্রথমে ছোট্ট একটা ফোঁটা, তারপর আস্তে আস্তে তালগাছের মতো বড়ো হয়ে উঠল কী ওটা? আগন্তুক এক জাহাজের মাস্তুল। আর সামনের বালিয়াড়ি পেরিয়ে ধু ধু করে উঠল নীল সমুদ্র। বঙ্গোপসাগর।
এই আসমুদ্রহিমাচল আমার বাংলা - পর্বত যার প্রহরী, সমুদ্র যার পরিখা।
ফরিদপুরের গাড়ি আসতে তখনও অনেক দেরি। রাজবাড়ির বাজারে বসে আছি। পাতলা কুয়াশায় মোড়া পঞ্চাশের আকালের এক সকাল। একটু দূরে স্টেশনের রাস্তায় মিলিটারি ছাউনির পাশে একটা অদ্ভুত জন্তু দেখলাম। আস্তে আস্তে চার পায়ে এগিয়ে আসছে। চেনা কোনো জন্তুর সঙ্গে তার মিল নেই। কুয়াশার মধ্যেও জ্বল জ্বল করছে তার দুটো চোখ। একা থাকলে ভয়ে মুর্ছা যেতাম। কেননা সেই চোখের দৃষ্টিতে এমন এক মায়া ছিল, যা বুকের রক্ত হিম করে দেয়।
আরও কাছে এগিয়ে এল সেই মূর্তি। রাস্তার ধুলো থেকে কী যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। তার জ্বলন্ত দুটো চো কুয়াশায় কী যেন খুঁজে খুঁজে ফিরছে। ঠিক মানুষের হাতের মতো তার সামনের দুটো থাবা। আঙুলগুলো যেন আগার দিকে একটু বেশি সন্তু। গায়ে একটুও লোম নেই। কোন জন্তু?
সামনাসামনি আসতেই স্তঙ্কিত হয়ে গেলাম। অমৃতের পুত্র মানুষ। বারো-তেরো বছরের উললা এক ছেলে মাজা পড়ে গেছে। হাঁটতে পারে না। তাই জানোয়ারের মতো চার পায়ে চলে। বাজারের রাস্তায় খুঁটে খুঁটে খায় চাল আর ছোলা।
ছুটে পালিয়ে এলাম স্টেশনে। কিন্তু আজও সেই দুটো জ্বলন্ত চোখ আমাকে থেকে থেকে পাগল করে। সু-হাতে সোনা ছড়ানো নদীমালার দিকে তাকিয়ে তার নিশ্বাস শুনি। সরু লিকলিকে আঙুল দিয়ে সেইসব খুনিদের সে শনাক্ত করছে—শহরে গ্রামে বন্দরে গন্ধে জীবনের গলায় যারা মৃত্যুর ফাঁস পরাচ্ছে, মাথা উঁচু করে বাঁচতে দিচ্ছে না যারা মানুষকে।
সেই দুটি জ্বলন্ত চোখ শান্তি চায়। বাংলার বুক জুড়ে সবুজ মাঠের সোনালি ফসলে, চাষির গোলাভরা ধানে ভরে উঠুক শান্তি। কারখানার কারখানায় বন্ধনমুক্ত মানুষের আন্দোলিত বাহুতে বাহু মেলাক শাস্তি। যুগ্ম নয় অনাহারে মৃত্যু নয় আর। কোটি কোটি বলিষ্ঠ হাতে এবার স্বাধীন সুখী জীবন, এবার শাস্তি।
যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের ঘনায়মান অন্ধকারে দুটি জ্বলন্ত চোখ জেগে আসমুদ্রহিমাচল এই বাংলায় পাহারা নিচ্ছে আর মাটি থেকে দুটো হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দু-পায়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে সে। তোমরাও হাত বাড়াও, তাকে সাহায্য করো।
---------xx---------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন